অনুন্নত দেশের অভিশপ্ত তকমা মুছে গেল চলতি সপ্তাহেই। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে সকল শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ। চ্যালেঞ্জ অনেক, তবে স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে বড় অর্জন সম্ভবত এটিই। সাধারণের রক্ত পানি করা শ্রমেই এ অর্জন।
মেহনতি কৃষক, প্রবাসী শ্রমিক আর গার্মেন্টস শ্রমিকের ঘাম ঝরানো অর্থে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের সতীর্থ হতে চান সবাই। কিন্তু পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশের সঙ্গী কে? দেশ আমার, দোষ কার?
প্রযুক্তির উদ্ভাসিত আভায় আলোকিত বিশ্ব। আলোর ধারায় প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে বাংলাদেশও। তবুও এই প্রযুক্তিই যেন অন্ধকার এনে দিচ্ছে কারও কারও জীবনে। ঘোর অন্ধকার! যে আলো একজনের জীবনে আশীর্বাদ, তা আরেকজনের জীবনে অভিশাপ যেন। ইন্টারনেট, ফেইসবুক, টুইটার, ই-মেইল, ইউটিউবে ভর করেই এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির দুনিয়া। অথচ এই ইন্টারনেটের ‘অন্ধকার’ গলিতেই হারিয়ে যাচ্ছে অনেকের আলোর দিশা।
ইন্টারনেটের এ ‘অন্ধকার’ পথে সামিল হচ্ছে সাধারণ ক্যামেরা থেকে মোবাইল ক্যামেরাও। একজন নির্যাতন করে, আরেকজন ছবি তোলেন, অন্যজন ইন্টারনেট আপলোড করেন। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ব্যক্তিগত বিষয় হাতিয়ে নিয়ে ব্ল্যাকমেইলের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। যেন অসভ্য এক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত মানুষরূপী অমানুষেরা।
তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে প্রকাশ্যে দিবালোকে নির্যাতন এখন হরহামেশাই দেখা যায়। আর এমন নির্যাতনের চিত্র ধারণ করাও যেন অতিস্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। প্রেমিক নির্যাতন করছেন প্রেমিকাকে, প্রেমিক নির্যাতন হচ্ছেন অন্যের হাতে। আবার ব্যক্তি কোলহের জের ধরে ভয়ঙ্কর হানাহানির ঘটনাও ঘটছে যেনতেনভাবেই। ঘটনা দিয়ে ঘটনার চাপা পড়ছে। আর সে ঘটনা সিনেমাকেও হার মানাচ্ছে। অন্ধকার চোরাবালিতে পা রেখে অনলাইন সেলিব্রিটি সাজতে এতটুকু দ্বিধাও করছেন না তরুণরা। অপরাধ চক্রের এ তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছেন না স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াও।
আর এসব অপরাধ জালের ফাঁদে পড়ে সবাই যেন দর্শক বনে যাচ্ছেন। জনবহুল রাস্তার মোড়ে একজন অসহায় ছাত্রীকে মারধর করে রক্তাক্ত করছে তার কথিত প্রেমিক, অন্যদিকে প্রেমিকের আরেক বন্ধু ছবি তুলছেন ঘুরে ঘুরে! বাকিরা দর্শক সেজে দেখছেন। কেউ কেউ না দেখার ভান করে সটকে পড়ছেন। প্রতিবাদ নেই, তদন্ত নেই, কিছু ক্ষেত্রে বিচার নেই। আবার খানিক পড়েই সেই নির্যাতনের ছবি বা ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল হচ্ছে। একটি ঘটনাই সমাজের চরম অবক্ষয় বহন করে। অথচ রোজ অসংখ্য ঘটনার জন্ম দিয়ে দুর্বিষহ করে তুলছে অসংখ্য মানুষ ও পারিবারিক জীবনকে। ‘অন্ধকার’ এ বাংলাদেশে আলোর পথ দেখাবে কে?
প্রতিবাদ না করাই কি রক্ষা? নীরবতাই তো সম্মতির লক্ষণ। আজ যে অন্যের জীবন বিষিয়ে তুলছেন, কাল যে সে আপনার জীবনে হামলে পড়বে না, তার নিশ্চিয়তা কী?
নাম প্রকাশ না করে রংপুর কারমাইকেল কলেজের এক ছাত্রী বলেন, দু’বছর আগের ঘটনা। ভুল বোঝাবুঝি থেকে বয়ফ্রেন্ড আমাকে ক্যাম্পাসে প্রাকাশ্যে নির্যাতন করে। তার আরেক বন্ধুকে দিয়ে তা ভিডিও করে। এরপর সম্পর্ক ভেঙে যায়। পরে পারিবারিকভাবে অন্য ছেলেকে বিয়ে করি। কিছু দিন আগে আমার স্বামীর কাছে ভিডিওটির সিডি করে পাঠিয়ে দেয়। এখন আমার স্বামীর সংসার ভেঙে যাওয়ার অবস্থা। এ বিচার কাকে দেব?
সমাজতাত্বিক, লেখক, গবেষক ড. মীজানুর রহমান শেলী বলেন, একটি রাষ্ট্র বা সমাজের উন্নয়ন বলতে বহুমাত্রিক ধারা বোঝায়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়েই সামগ্রিক উন্নয়ন বোঝায় না। সমাজের অবক্ষয় তো ভয়ঙ্কর রূপ নিল গত কয়েক বছরে। মানুষ তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে কোথাও আর নিরাপদ নয়। রাজনৈতিক, সামাজিক আর সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের দাবানলে পুড়ছে মানুষের মন। এর জন্য ভঙুর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর শিক্ষা ব্যবস্থাকেই মূলত দায়ি করছি।
তিনি আরও বলেন, প্রযুক্তির দোষ দিয়ে নিজের দায় এড়ানো যায় না। দায় সবার। যদি এখনই আমরা এই অবক্ষয় রোধ করতে না পারি, তাহলে বিপদ সবারই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন