ছোটবেলা হেমন্তের উন্মুক্ত হাওর থেকে দেখতাম আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে উত্তরে ওই দূর মেঘালয় পাহাড়। মেঘালয় রাজ্যের ওই পাহাড়শ্রেণির কোলঘেষে খাসিয়া সম্প্রদায়ের এক গ্রামে কাকন বিবির জন্ম। বিশাল পাহাড়ের মত এক দুর্জয় সাহসী হৃদয় নিয়ে তিনিও জন্মেছিলেন। একাত্তরে পাক বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে অসমসাহসী যুদ্ধে লড়াই করেছেন এই বীরনারী। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী এই নারীর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা শুনেছিলাম অনেক আগেই। কিন্তু অনিসন্ধিৎসু চোখে জানার সুযোগ পাই আরও পরে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি।
অনার্স ফাইনাল ইয়ারে আমাদের একটি মনোগ্রাফ করতে হয়েছিল। বিভাগের একজন অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে রীতিমতো খেটে গবেষণা করে এই মনোগ্রাফটি উপস্থাপন করতে হয়। মনোগ্রাফটির টাইটেল হিসেবে নিয়েছিলাম ‘দ্য রোল অব ফ্রিডম ফাইটার্স ইন লিবারেশন ওয়ারঃ সেক্টর ফাইভ।’ এই মনোগ্রাফের কাজ করতে যেয়ে আমার সেক্টর-৫ নিয়ে কিছু পড়াশোনার সুযোগ হয়। অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করারও সৌভাগ্য হয়। তাদের কাছে গিয়েছি। খুঁজে খুঁজে অনেককে বের করেছি। কথা বলেছি। তাদের কাছে যুদ্ধদিনের সংগ্রাম, অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা, গৌরবগাথা শুনেছি। সে সময়েই আমি কাকন বিবি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানার সুযোগ পাই। অসুস্থ থাকায় সে সময় তাঁর সাক্ষাৎকার নেয়া সম্ভব হয়নি কিন্তু সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে তাঁর সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। কাকন বিবি ধর্মান্তরিত হয়ে নতুন নাম গ্রহণ করেছিলেন নূরজাহান বেগম। মুক্তিযুদ্ধের সময় মাত্র ৩ মাসের কন্যা সন্তানকে রেখে যুদ্ধে যান। প্রথম দিকে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন। পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
রাজকার ও পাকবাহিনী মিলে তাকে একটানা নির্যাতন করে। মৃত ভেবে ফেলে রেখে তারা চলে যায়। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে উদ্ধার করে বালাট সাব সেক্টরে নিয়ে যান। চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রুষার পর সুস্থ হলে তিনি সীমান্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে একজন যোদ্ধার প্রশিক্ষণ নেন। পাঁচ নাম্বার সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে তিনি কাজ করতেন। পাক বাহিনীর চলাচল ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কমান্ডারকে সরবরাহ করতেন। সে তথ্যের ভিত্তিতে অপারেশন পরিকল্পনা করা হত। তিনি সক্রিয়ভাবে অনেক অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। টেংরাটিলা সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। পাক বাহিনীর চলাচল রোধে সিলেট-সুনামগঞ্জ রোডে জাউয়া বাজার ব্রিজ উড়িয়ে দিতে তাঁর সরবরাহ করা তথ্যের ভিত্তিতে অপারেশন পরিচালনা করা হয়।
দেহ-মনে রাজাকার ও পাক বাহিনীর নির্যাতনের অনেক ক্ষত নিয়ে এই বীরনারী লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন দুই যুগেরও বেশি সময় । সে সময় এদেশে মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত ছিলেন। নিয়মিত বাহিনীর ভেতর কর্মরত অনেক মুক্তিযোদ্ধা সাজানো কোর্ট মার্শালে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এদেশের বুকে নেমে এসেছিল তখন জলপাই রঙের সামরিক অন্ধকার। সে অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিলেন অনেক দেশপ্রেমী মানুষ। হারিয়ে গিয়েছিলেন দূর নিভৃত পল্লীর কাকন বিবিও। যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে বানভাসি সব হারানো মানুষের মত এক দুঃসহ জীবন কেটেছে তাঁর। তিনি প্রথম স্থানীয় এক সাংবাদিকের মাধ্যমে গণমাধ্যমে আলোচনায় আসেন। সে সময় ছাতক উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নে বসবাসের জন্য একটি ঘর করে দেন স্থানীয় সাংসদ মুহিবুর রহমান মানিক।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে তাঁর জন্য এক একর খাস জমি বরাদ্দ করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গৌরবময় ভূমিকার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করেন। কিন্তু সে ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিক গেজেট আজ অবধি প্রকাশ হয়নি। ভুয়া অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট দেয়ার দুর্নাম কুড়ালেও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় আজো সত্যিকার একজন যোদ্ধা কাকন বিবির ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নেয়নি। এতো উদাসীন থাকার কারণ হয়ত তোপখানা রোডে মন্ত্রী ও সচিবের দরবারে কাকন বিবির তদবির করার কেউ ছিলেন না।
বর্তমান দোয়ারা বাজার উপজেলা চেয়ারম্যান পাঁচ নাম্বার সেক্টরের সহযোগী যোদ্ধা বীর প্রতীক ইদ্রিস আলীর সঙ্গে এই লেখকের আজ কথা হয়। তিনি কাকন বিবির একাত্তরে আত্মত্যাগের কাহিনী স্মরণ করে গভীর শোক প্রকাশের পাশাপাশি দুঃখ ও ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনিও কাকন বিবির স্বীকৃতি ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছেন কিন্তু কোন কাজ হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ যে এদেশের সকল মানুষের যুদ্ধ ছিল এই আদিবাসী বীরনারী সে গৌরবগাথা রচনা করে গেছেন আমাদের জন্য। অনেকদিন ধরে তিনি রোগশোকে ভুগছিলেন। অবশেষে গত বুধবার রাত সাড়ে এগারোটায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একাত্তরের উজ্জ্বল নক্ষত্রেরা একে একে চলে যাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে আমাদের এতো কার্পণ্য কেন? কেন তিনি সাময়িক সনদের বাইরে একজন বীর প্রতীকের সকল প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা ও পূর্ণ সম্মান নিয়ে যেতে পারলেন না। এই অবহেলার দায়ভার কার, কে নেবে? একাত্তরের নক্ষত্রেরা একে একে চলে যাচ্ছেন। এই মহিয়সী লড়াকু নারীও অবশেষে চলে গেলেন। এই দেশ ও জাতির মুক্তিসংগ্রামে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল আত্মত্যাগের স্মৃতি আমরা কখনো ভুলব না। তাঁর সংগ্রামী স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন