কনকনে শীতের রাতে ঘটে যাওয়া একটি হত্যাকাণ্ড। ২৬ জানুয়ারির গভীর রাতে খুন হওয়া যুবকের খুনীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে । ঘটনার প্রায় দুই মাস পরও এখনো ক্লুলেস।
সেদিনের কনকনে শীতে গুরুতর আহত যুবক ছুটতে ছুটতে রাজধানীর টিকাটুলির সালাউদ্দিন স্পেশালাইজড হাসপাতালে ঢুকে পড়েন । আনুমানিক ৩৫ বছর বয়সি যুবকের শরীর ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত। হাসপাতালের অভ্যর্থনাকক্ষের সামনে ঢলে পড়েন তিনি।
যুবকের বুকের ডান পাশে, ডান হাতের ওপর, কবজি এবং ডান দিকের হাঁটুতে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন। হাসপাতালে থাকা অন্য রোগীর স্বজনেরা বাইরে গিয়ে টহল পুলিশে খবর দেয়। সেখান থেকে যুবককে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে। যাওয়ার সময় সঙ্গী পুলিশকে কেবল নিজের নামটি অস্ফুট স্বরে বলেন‘ইব্রাহিম’।
ইব্রাহিমের পকেটে তখন ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ও একটি মুঠো ফোন। সেই ফোন দিয়েই পরিচয় খুঁজে পায় পুলিশ। পুরো নাম মো. ইব্রাহিম। বাড়ি খুলনা জেলার সোনাডাঙ্গা এলাকায়। পুলিশের কাছ থেকে খবর পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান ইব্রাহিমের আত্মীয়-স্বজন। তখন সবই শেষ, ইব্রাহিমের নিথর দেহ পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। ময়নাতদন্ত শেষ করে ইব্রাহিমের লাশ নিয়ে দাফন করা হয় খুলনায়। এ ঘটনায় গেন্ডারিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন ইব্রাহিমের ভগ্নিপতি মো. আবদুল হক।
ঘটনার প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেছে। ইব্রাহিম হত্যা রহস্যের জট এখনো খোলেনি। ধরা পড়েনি কোনো আসামি। ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা গেন্ডারিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাজ্জাদুজ্জামান বলছেন, রহস্য উদ্ঘাটনে অনেকটাই এগিয়েছেন তারা। ইব্রাহিমের স্বজনরা বলেছেন, ঘটনার রহস্য এখনো তাদের অজানা।
নিহত ইব্রাহিমের ভগ্নিপতি আবদুল হকের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, খুলনার সোনাডাঙ্গার শেখপাড়ায় ইব্রাহিমের ওয়ার্কশপের ব্যবসা ছিল। ব্যবসার কাজে ঢাকায় এসে চট্টগ্রামে চলে যান। সেখান থেকে ২৬ জানুয়ারি রাত চারটার দিকে সায়েদাবাদ থেকে টিকাটুলি যাওয়ার পথে ২৫/সি করাতিটোলা স্বামীবাগের সামনের সড়কে অজ্ঞাতনামা যুবকেরা ধারালো চাকু দিয়ে ইব্রাহিমের ডান বুকে, ডান হাত ও কবজি এবং ডান পায়ের হাঁটুতে আঘাত করে। এ সময় ইব্রাহিমের চিৎকারে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। তার পকেটে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোন থাকলেও সেগুলো ছিনিয়ে নেয়নি দুর্বৃত্তরা।
আবদুল হকের অভিযোগ, ইব্রাহিম গুরুতর আহত অবস্থায় সালাউদ্দিন হাসপাতালে গেলেও সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক রোগীর কোনো চিকিৎসা করেননি। এমনকি রক্তক্ষরণ বন্ধেরও কোনো ব্যবস্থা করেননি। ভোরে ঢাকা মেডিকেলে ইব্রাহিম মারা যান। ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকেরা আবদুল হককে জানান, শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণের জন্য তার শ্যালকের মৃত্যু হয়।
তবে ইব্রাহিমের চট্টগ্রামে যাওয়ার বিষয়টি জানতেন না তার ভগ্নিপতি আবদুল হক। পুলিশের কাছ থেকে তিনি এ বিষয়ে শুনতে পেরেছেন। আবদুল হক জানান, ইব্রাহিম নৌযান নির্মাণের সামগ্রী সরবরাহ করতেন। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি রাজনীতিও করতেন। খুলনায় ২০ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তবে ইব্রাহিমের কারও সঙ্গে কোনো ধরনের শত্রুতা ছিল না।
আবদুল হক বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য ইব্রাহিমের মালপত্র কেনার কথা ছিল। যশোরের নওয়াপাড়ায় ওই প্রতিষ্ঠানের কার্গো নির্মাণের জন্য এসব মালামাল সরবরাহের কাজ পেয়েছিলেন তিনি। তাদের কাছ থেকে অগ্রিম সাত লাখ টাকা নিয়ে মৃত্যুর দুদিন আগে ২৪ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন ইব্রাহিম। ঢাকার নবাবপুরের একটি হোটেলে তিনি ওঠেন। কিন্তু হোটেলের নাম-ঠিকানা জানা যায়নি। ২৫ জানুয়ারি সকাল থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত কয়েকবার ইব্রাহিম আবদুল হকের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন। তবে চট্টগ্রামে যাওয়ার কথা ইব্রাহিম বলেননি।
ইব্রাহিমের ব্যাপারে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে সালাউদ্দিন হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্য জানায়নি।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ইব্রাহিমকে কোথায় কোপানো হয়েছে, এ ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে স্বামীবাগ নয়, ওয়ারী এলাকার কোনো একটি জায়গায় তাকে আঘাত করা হয়েছে। তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ইব্রাহিম হত্যা মামলার তদন্ত করা হচ্ছে। এর মধ্যে পরিচিত লোকেরা পূর্বপরিকল্পনায় ইব্রাহিমকে হত্যা করে থাকতে পারে। ইব্রাহিম রাজনীতি করতেন। তাই রাজনৈতিক কারণেও হত্যাকাণ্ডটি হতে পারে। এ ছাড়া ছিনতাইকারী চক্রও ইব্রাহিমকে মেরে ফেলতে পারে। ছিনতাইকারীদের হামলাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, সুঠামদেহী ছিলেন ইব্রাহিম। তার উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। ছিনতাইকারীরা তার কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে থাকতে পারে। সে সময় বাধা দেওয়াতে ইব্রাহিমকে ছুরিকাঘাত ও কোপানো হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু ইব্রাহিমের চিৎকার করাতে কিংবা অন্য কেউ হামলার সময় ঘটনাস্থলে চলে আসায় ছিনতাইকারীরা টাকা না নিয়েই পালিয়ে যায়। তবে অন্য বিষয়গুলোও বিবেচনা করে ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে।
তবে ইব্রাহিমের স্বজনদের মতে, ছিনতাইকারী হলে ইব্রাহিমকে হত্যার পর তারা টাকা ও মোবাইল নিয়ে যেত। কিন্তু কোপানোর পর টাকা নিয়ে যায়নি দুর্বৃত্তরা। পেশাদার খুনিরা যেভাবে কাউকে হত্যা করে, ইব্রাহিমকেও একইভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।
ইব্রাহিম হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গেন্ডারিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাজ্জাদুজ্জামান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, হত্যার পুরো ঘটনাটি ক্লুলেস (সূত্রবিহীন)। আমরা তার জবানবন্দি নেয়ারও সুযোগ পাইনি। তাই স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না, এটি ছিনতাই, নাকি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তবে রহস্য উদ্ঘাটনে বেশ অগ্রগতি হয়েছে বলে জানান তিনি।
সূত্র: প্রথম আলো
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন