মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বামী ও ছয় শহীদ সন্তানের জননী মেহেরজান বিবি এখন ভিক্ষা করে বেঁচে আছেন। সব হারিয়ে তার ঠাঁই হয়েছে ফেনী সদর উপজেলার ধর্মপুর আবাসন ও আশ্রয়ন প্রকল্পের ৩ নং ব্যারাকের ১১ নং কক্ষে।
৮৮ বছর বয়সী অসহায় মেহেরজান বিবি প্রতিদিন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করেন। তার দুঃখে ভারাক্রান্ত জীবন কাহিনী বলতে বলতে অঝোরে চোখ বেয়ে নেমে আসে বেদনার অশ্রু। নিজে কাঁদেন এবং অন্যকেও কাঁদান।
দুই বগলে স্ট্রেচারে ভর দিয়ে দু’মুঠো ভিক্ষার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মেহেরজান। চরম অসহায়ত্বের মাঝে দিন কাটছে তার। সহায় সম্বলহীন মেহেরজারেন আকুতি বেঁচে থাকার।
চাঁদপুর সদর উপজেলার বাবুরহাটস্থ ২৬ নং দক্ষিণ তরপুরচন্ডী গ্রামে ১০ অক্টোবর ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন মেহেরজান বিবি। তার বাবা ইব্রাহীম উকিল, মা বিবি হনুফা। তারা ছিলেন ছয় ভাই-বোন।
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার ৬ নং চরছান্দিয়া ইউনিয়নের বড়ধলী হাজি বাড়ির মরহুম মমতাজ উদ্দিনের ছেলে সুবেদার মেজর এটিএম সামসুদ্দিনের সঙ্গে মেহেরজান বিবির বিয়ে হয়। পঞ্চাশের দশকে বড়ধলী গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হলে নিঃস্ব হয়ে তারা শহরে চলে আসেন। বাসা ভাড়া করেন ঢাকার মিরপুর-১ নম্বরে জালাল দারগার বাড়িতে।
মেহেরজান বিবির ভাষ্যমতে, তার আট ছেলে ও দুই মেয়ে ছিল। তার ছয় ছেলে এবং স্বামী এটিএম সামসুদ্দিন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ছেলেরা হলেন- ছায়েদুল হক (তৎকালীন সিলেটে রিলিফ অফিসার পদে কর্মরত ছিলেন), দেলোয়ার হোসেন, বেলায়েত হোসেন, খোয়াজ নবী, নুরের জামান ও আবুল কালাম। বাকি দুই ছেলে শাহ আলম ও শাহ জাহান তার খোঁজখবর নেন না এবং তাদের সন্ধানও তিনি জানেন না। দুই মেয়ে মরিয়ম বিবি ও হাসনা বিবিও মারা গেছেন।
মেহেরজান বিবি জানান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনী তার স্বামী ও ছয় সন্তানকে হত্যা করে থেমে যায়নি। সেইসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার জানতে পেরে মিরপুরে তাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে তিনি ঢাকার মিরপুরে বাংলা মিডিয়াম হাই স্কুলের (বর্তমানে মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়) শিক্ষিকা ছিলেন।
মেহেরজান বিবি জানান, স্বাধীনতার পর তার দুঃখ-কষ্টের কথা শেখ মনির দৈনিক বাংলা বানী পত্রিকায় ছাপা হলে তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর নজরে আসেন। বঙ্গবন্ধু তাকে ও তার এক পুত্রবধূ করফুলের নেছাকে ডেকে নিয়ে দুই হাজার টাকা করে অনুদান দেন এবং বঙ্গবন্ধু মেহেরজান বিবিকে পবিত্র হজ পালন করান।
মুক্তিযুদ্ধের পর স্বামী-সন্তানদের শহীদ হওয়ার খবরে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিনেও তার পুরাপুরি মানসিক সুস্থতা ফিরে আসেনি। স্বজনদের হারিয়ে চরম অসহায়ত্বে পড়ে ভিক্ষার পথ বেছে নেন তিনি।
২০০৯ সালে ফেনী রেলস্টেশনে ভিক্ষা করতে দেখে এক জিআরপি পুলিশ তাঁকে ফেনী জেলা প্রশাসনে পাঠায়। তখন জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তাকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয় ধর্মপুর আবাসন প্রকল্পে। সেই থেকে তিনি এখানে বসবাস করছেন।
সোনাগাজী উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ নাসির উদ্দিন জানান, মেহেরজান বিবি সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। তবে কোনো কাজ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে তার স্বামী-সন্তান শহীদ হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি গেজেটে তার নামও দেখেছি। কিন্তু তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সহায়তা করা হয়নি।
জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ফেনী জেলা ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডার আবদুর রহমান মজুমদার বলেন, দীর্ঘদিন থেকে মেহেরজান বিবির সঙ্গে আমার সম্পর্ক। তিনি আমাকে স্নেহ করেন এবং ছেলে বলে ডাকেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি তার স্বামী-সন্তান হারিয়েছেন।
এ বিষয়ে ফেনীর জেলা প্রসাশক মনোজ কুমার রায় বলেন, আশ্রায়ন প্রকল্পে সুবিধাভোগীর একজন মেহেরজান। আমরা তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছি। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার ছয় সন্তান ও স্বামী হারিয়েছেন। এছাড়া তার অনেক করুন কাহিনী শুনেছি। আমরা তাকে সার্বিক সহযোগিতা করবো।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন