গ্রামে যারা বড় হয়েছেন বা এখনো আছেন তারা গ্রাম পুলিশ শব্দটির সঙ্গে বেশ পরিচিত। কিন্তু শহরে যাদের বাস তারাও শব্দটির সঙ্গে একেবারে অপরিচিত নন। এর পাশাপাশি মাধ্যমিকের পাঠ্য বইয়েও গ্রাম পুলিশের পরিচিতি রয়েছে।
গ্রামের মানুষের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে নিজেরা কতটুকু সুবিধা পান তারা? কীভাবে চলে তাদের সংসার? তৃণমূল পর্যায়ের এ বাহিনীর পোশাক আছে, কিন্তু সেই পোশাকের আদৌ ক্ষমতাই বা কতটুকু? জীবনে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হন তারা? তাদের জীবনের অজানা দুঃখ কষ্টের গল্পগুলোর শেষ পর্ব থাকছে আজ।
প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মধ্যে চিকিৎসাও একটি। দেশের বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা চিকিৎসা ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা পেলেও গ্রাম পুলিশরা তা পান না। সদর হাসপাতাল বা সরকারি কোনো স্বাস্থ্য ক্লিনিকে গেলেও তাদের লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা নিতে হয়। তাদের জন্য আজও হয়নি কোনো আলাদা স্বাস্থ্য সেবা কার্ড। দেওয়া হচ্ছে না কোনো চিকিৎসা ভাতাও। ফলে অনেকে জীবনের মধ্য পথে বা শেষ জীবনে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেও চিকিৎসার অভাবেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন। এ ক্ষেত্রে তারা ইউনিয়ন পরিষদের যে চেয়ারম্যানের অধীনে কাজ করেন তারাও কোনো ধরনের টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করতে চান না বলে অভিযোগ আছে।
ইউনিয়ন পরিষদের কাজ করতে গিয়ে কর্তব্যরত অবস্থায় অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়লেও চিকিৎসার জন্য কোনো ধরনের খরচের টাকা বা ভাতা পান না। বাধ্য হয়ে তাদের রোগকে শরীরে পুষে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চলতে হয়। আবার কেউ কেউ পঙ্গুত্ব বরণ বা প্যারালাইজড হয়ে বছরের পর বছর বিছানায় পড়ে থাকলেও কোনো সাহায্য পান না। তাদের মৃত্যুতে পুরো পরিবারের সদস্যরা পড়ে যান সীমাহীন দুঃখ-কষ্টে।
২০১৫ সালের দিকে এক দুপুরে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যর মোটর সাইকেলে চড়ে এক ব্যক্তির বাড়িতে যাচ্ছিলেন বান্দরবান জেলার রুপনীপাড়া গ্রামের চকিদার বেলাল হোসেন। পথে দুর্ঘটনার শিকার হয় মোটর সাইকেলটি। এতে পায়ের হাঁটুর জয়েন্ট খুলে যায় বেলালের। অসুস্থ হয়ে তিনি দীর্ঘদিন পড়ে ছিলেন হাসপাতাল ও বাড়ির বিছানায়। ঘটনাস্থল থেকে তাকে যে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল তার পুরো টাকাই তাকে পরিশোধ করতে হয়েছিল। অথচ তাকে সেদিন দেখতে গিয়েছিলেন স্থানীয় পৌরসভার মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ আরও অনেকে।
বেলালের গ্রামের আরেক চকিদার মোফাজ্জল জানান, গত তিন বছরে তিনি দুবার টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। চিকিৎসক তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পরামর্শ দিয়েছিল কিন্তু তিনি টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি।
যশোরের চৌগাছা উপজেলার গ্রাম পুলিশ রেজাউল প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমরা অন্যকে সেবা দিই কিন্তু আমাদের রোগ শোকে কারো কোন সাহায্য জোটে না। ডাক্তাররা কয় তোমরা তো সরকারি চাকরি কর।’
ধামরাই উপজেলার নরসিংহপুর গ্রামের ৬০ বছর বয়সী দরবেশ আলী দায়িত্ব পালনের সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে জানানো হয় তার প্যারালাইজড হয়েছে। এ ঘটনার পর বেশ কয়েক বছর বিছানায় পড়েছিলেন সেই দরবেশ আলী। কিন্তু তার কোনো চিকিৎসা হয়নি। সবশেষে বিনা চিকিৎসায় মারা যান তিনি।
দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার মমিনপুর ইউনিয়নের আরিফুল ইসলামের বাবা ছিলেন গ্রাম পুলিশ সদস্য। তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, ‘বাবা অনেকদিন ধরে অসুস্থ আছিল। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ থাকি কোনো টাকা পয়সা দেয় নাই। এমনকি চেয়ারম্যান চাচাও কোনো খোঁজ খবর নেয় নাই।’
আরিফুল ইসলাম জানান, মাত্র তিন হাজার টাকায় তার দুই বোন, মা, স্ত্রী, দুই সন্তানের সংসার চালাতেত হয়। চিকিৎসার খরচও বহন করতে হয় এই টাকা থেকে। তার বাবা অনেক দিন অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলেও টাকার কারণে ভালো চিকিৎসক দেখাতে পারেননি তিনি।
কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের বরডইল গ্রামের রবিউল গাজী জুয়েল পেশায় দফাদার। তার বাবাও ছিলেন গ্রামের একজন দফাদার। গত বছরে রমজানের সময় তিনি ইউনিয়ন পরিষদের ছাদে উঠে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করছিলেন। ওই সময় হঠাৎ করে ছাদ থেকে পড়ে যান। পরে তাকে উদ্ধার করে ইউনিয়নের লোকজন স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করায়। পরে তাকে একটি ব্যথানাশক ওষুধ খাইয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হলে রাতে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে পাড়া প্রতিবেশীরা দ্রুত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। এরপর তিনি অসুস্থ হয় দীর্ঘ এক মাস বিছানায় ছিলেন। কিন্তু কেউ তার কোন খোঁজ-খবর নেয়নি।
দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে জুয়েল বলেন, ‘পুরো মাস আমাকে স্ট্রেচারে ভর দিয়ে চলাফেরা করতে হয়েছে। আমার অসুস্থতায় ইউনিয়ন পরিষদ এমনকি স্থানীয় সরকার বা সরকারিভাবে কোনো ভাতা বা সহযোগিতা পাইনি। এমনকি কেউ আমাকে দেখতেও আসেনি। আমরা আসলে অনেকের করুণায় বেঁচে আছি। আমাদের অনেকে আছে তারা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে মৃত্যুকে বরণ করে কিন্তু কোনো সহযোগিতা পায় না।’
বাংলাদেশ গ্রাম পুলিশ বাহিনী কল্যাণ ফান্ডের সভাপতি উজ্জল খান প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমরা মানুষের সেবা দেই, আমাদের সেবা করার কেউ নেই। সারাদিন কাজ করতে হয়। কাজের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার জন্য স্থানীয় সরকার বা ইউনিয়ন পরিষদ এবং চেয়ারম্যান কেউ এগিয়ে আসেন না। নিজের পকেটের টাকা দিয়েই চিকিৎসা করাতে হয়।’
উজ্জল জানান, দেশের বিভিন্ন গ্রামে কর্মরত গ্রাম পুলিশরা অসুস্থ হয়ে মাসের পর মাস পরে থাকলেও সরকার বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাদের কোনো চিকিৎসা ভাতা বা সাহায্য দেওয়া হয় না। বাধ্য হয়ে তারা নিজেদের নিরাপত্তায় একটি কল্যাণ ফান্ড গঠন করেছেন। কিন্তু তারা যা আয় করেন তা দিয়ে সেই কল্যাণ ফান্ডের তহবিল বৃদ্ধি করাও খুব কঠিন বলে মনে করেন তিনি।
নব্বইয়ের দশক থেকে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার গ্রাম পুলিশ দুর্ঘটনা ও দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু তাদের চিকিৎসায় কোনো সহযোগিতা তারা পাননি বলেও জানান তিনি।
এদিকে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ প্রিয়.কমকে বলেন, ‘এ বাহিনীতে প্রায় ৪৬ থেকে ৫০ হাজারের মতো মানুষ কাজ করছে। অথচ তাদের কোনো বেতন নেই, ভাতা নেই। আর ভাতা থাকলেও তা সঠিকভাবে সঠিক সময়ে দেওয়া হয় না। তারা কী কাজ করছে তা দেখভাল করার মতো লোকও নেই। আর তাদের কাজেরও কোনো মূল্যায়ন নেই। তাদের প্রশিক্ষণ নেই, পোশাক নেই। এভাবে তো একটা বাহিনী চলতে পারে না। এ কারণে সরকারকে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর এতে তাদের বেতন, ভাতাসহ অন্যান্য কি কি সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে সে বিষয়গুলো আসবে। এ জন্য গ্রাম পুলিশকে পুর্নগঠন করতে হবে।’
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, ‘এ বিষয়ে বেশি কিছু জানি না। বিষয়টি দেখেন মন্ত্রী, বা সচিবের সঙ্গে কথা বলেন। তারা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।’
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘তারা তো ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কিছু টাকা-পয়সা পায়। আর তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য তো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে একটা প্রস্তাব আসতে হবে। ইউনিয়ন কাউন্সিল কত দেবে সেটা আগে তারা ভাবুক, তারপর আমরা ভাবব। কারণ আমাদের তো একটা প্রসেস ফলো করতে হবে।’
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন