ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) ভবনে ৮ এপ্রিল দিন পেরিয়ে গভীর রাতে যে হামলা হয়, ওই সময় সেখানে বিভিন্ন ধরনের ভূমিকা পালন করেছে আটটি গ্রুপ। এর মধ্যে হামলায় অংশ নেয় দুটি গ্রুপ। আর অন্য ছয়টি গ্রুপ উপাচার্যকে রক্ষাসহ নানান ভূমিকা পালন করে।
প্রিয়.কমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ওই রাতের হামলার সময়ের চিত্র। ওই সময়ের কিছু অপ্রকাশিত ছবিও পাওয়া গেছে। এসবে মুখে কাপড় বাঁধা কয়েকজন হামলাকারীকে দেখা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, হামলা শুরু হয় রাত ১টা ২০ মিনিট থেকে ১টা ৩০ মিনিটের মধ্যে। চলেছে ১টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত।
উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেছেন, হামলা শুরু হয় ১টা ২৫ মিনিটে। ফটক ভেঙে বাসভবনের ভেতর প্রবেশ করে ১টা ৩০ মিনিটের দিকে। তখন তার মেয়ে, স্ত্রী, ছেলে সবাই আলাদা হয়ে পড়েন।
তবে এক সপ্তাহ হয়ে গেলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনো হামলার সঙ্গে জড়িত কাউকে সনাক্ত বা গ্রেফতার করতে পারেনি। শুরু থেকেই উপাচার্য বলছেন, হামলাকারীরা বহিরাগত।
হামলায় দুই গ্রুপ
উপাচার্য ভবনে হামলায় দুটি গ্রুপের সদস্যরা অংশ নেন। এই দুই গ্রুপের মধ্যে একটি ছিল প্রশিক্ষিত ও বহিরাগত। তারা যেভাবে অল্প সময়ের মধ্যে এই তাণ্ডব চালিয়ে পালিয়ে গেছেন–তাতে এমনটাই ধারণা করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রত্যক্ষদর্শী, তদন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অন্য গ্রুপে যারা ছিল তারা সাধারণ আন্দোলনকারীদের কয়েকজন। তারা অতিউৎসাহী হয়ে সেখানে প্রবেশ করেছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন।
হামলার সময়ে উপাচার্য ভবনের ভেতরে উপস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমরা ওই রাতে ঢাকা মেডিকেলের সামনে থেকে ভাত খেয়ে রাত ১টার দিকে টিএসসির মোড়ে এসে বসেছিলাম। সে সময়ে শাহবাগ এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হচ্ছিল। রাত দেড়টার সময় দেখি ৪/৫ জন ছেলে দৌড়ে ভিসি স্যারের বাসভবনের দিকে যাচ্ছেন। তখন আমিসহ কয়েকজন বিষয়টি জানার জন্য তাদের পেছনে পেছনে ভিসি স্যারের বাসভবনের গেটে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি প্রায় ১৫/২০ জন মিলে বাসভবনের মেইন গেট ভাঙার চেষ্টা করছে। তারা রড, বাঁশ, হকিস্টিক ইত্যাদি দিয়ে গেটে আঘাত করছিল। এমন সময়ে ৩/৪টি ছেলে গেটের পাশের দেয়ালের ওপরের কাঁটাতারের নিরাপত্তাবেস্টনী ভেঙে দেয়ালে উঠে গাছ বেয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর সেই প্রবেশকারীরা ভেতর থেকে মেইন গেট খুলে দেয়। আর গেট খোলার সাথে সাথেই ৪০/৫০ জন মিলে প্রবেশ করে ভেতরে। তারা সব জিনিসপত্র ভাঙতে শুরু করে দেয়। এদের মধ্যে প্রায় ৩০ জনই ছিল মুখে কাপড় বাঁধা অবস্থায়। এ সময়ে গেট খোলা পেয়ে কিছু আন্দোলনকারীও ভেতরে ঢুকে যায়।’
‘হামলার দৃশ্য আর সহ্য করতে না পেরে প্রবেশ করি বাসার ভেতরে। নিচতলায় সব কিছু তারা তছনছ করে দিয়েছে। দৌড়ে উঠে যাই ওপরের তলায়, গিয়ে দেখি ভিসি স্যারকে কয়েকজন মিলে চতুর্দিকে ঘিরে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। আর মুখ বাঁধা কয়েকজন হামলাকারী ভিসি স্যারের ওপরে বারবার হামলা চালাতে চাচ্ছেন। আমিও তখন স্যারকে বাঁচাতে যোগ দিলাম। এ সময়ে ভবনের ভেতরে ও বাইরে জিনিসপত্র ভাঙচুর করে তাতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন হামলাকারীরা। এমন সময়ে আমি দ্বিতীয় তলা থেকে নিচের হামলাকারীদের ছবি তুলছিলাম। হঠাৎ একজন আমার ফোন কেড়ে নিয়ে যায়। আমি তখন আবারো ঘরের ভেতরে চলে যাই। প্রায় মিনিট ১৫ পরে আমরা ৭/৮ জন মিলে স্যারকে নিচে নামায়ে আনি। এ সময় কিছু হামলাকারীরা পালিয়ে যাচ্ছিল। আর ওই সময়ে বাসভবনে প্রবেশ করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-অ্যাপায়ন সম্পাদক আরিফুজ্জামান ইমরানসহ ১০/১২জন নেতাকর্মী। তারা ভেতরে প্রবেশ করেই হামলাকারীদের পেটানো শুরু করে, তখন সবাই পালিয়ে যায়। তাদের হাতে একজন হামলাকারী আটক হয়েছিল, তবে সেও পরে পালিয়েছে,’ বলেন প্রত্যক্ষদর্শী ওই শিক্ষার্থী।
ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, “স্যারকে নিচে নিয়ে যাওয়ার মিনিট দশেক পরে সেখানে আসেন জাহাঙ্গীর কবির নানক (আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক)। তিনি এসে প্রথমে একটি ফোন করেন। ফোনে তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাস এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে আপনি দ্রুত পুলিশ পাঠান’।
জাহাঙ্গীর কবির নানক দ্বিতীয় ফোনটি করেন ফায়ার সার্ভিসে। এরপরে তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগকে ফোন করে বলেন ভিসির বাসায় আসতে। তারও ৫/৭ মিনিট পরে সোহাগ ও জাকির (ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন) ঘটনাস্থলে চলে আসেন।’’
হামলা ঠেকাতে ছয় গ্রুপ: প্রথম গ্রুপ সংবাদকর্মীদের
উপাচার্যকে হামলাকারীদের হাত থেকে প্রথমে বাঁচিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকরা। সাংবাদিকদের গ্রুপটি রাত ১টা ৩৫ মিনিটের দিকে ভিসির বাসায় প্রবেশ করেন। তারা ৫/৭ জন বাসভবনে প্রবেশ করে উপাচার্যকে ঘিরে রাখেন। হামলাকারীদের কাছ থেকে বাঁচাতে এক সংবাদকর্মীর সঙ্গে এক হামলাকারীর হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। ছাত্রলীগ নেতারাও স্বীকার করেছেন, উপাচার্যকে রক্ষা করেছিলেন সাংবাদিকরাই।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের উপ-অ্যাপায়ন বিষয়ক সম্পাদক আরিফুজ্জামান ইমরানও প্রিয়.কম-এর কাছে এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। উপাচার্যকে রক্ষা করতে ছাত্রলীগের যে দলটি প্রথম বাসভবনে ঢুকেছিল, এই নেতাই ছিলেন তাদের নেতৃত্বে।
ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আশিক আব্দুল্লাহ অপু ওই সময় অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে উপাচার্যকে রক্ষার চেষ্টা করেন। তিনি প্রিয়.কমকে বলেন, ‘হামলাকারীরা যখন গেটে ভাঙচুর করছিল, বাসায় হামলা চালাচ্ছিল, আমরা সেসময় ওখানেই ছিলাম। এরপর আমরা যখন ভিতরে ঢুকলাম রাত দেড়টার দিকে, তখন আমরা গিয়ে দেখি ওখানে আগে থেকেই আমাদের কিছু বড় ভাই সাংবাদিক আছেন ভিসি স্যারে কাছে। স্যারকে বাঁচাতে আমিও এগিয়ে যাই। এ সময় হামলাকারীরা বাসার গেটে, ভেতরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল। সেই মুহূর্তে স্যার নিচে নেমে আসছিলেন। আমরা তখন স্যারকে প্রটেক্ট করছিলাম। স্যার দোতলায় সিঁড়ির ওপরে ছিলেন। ওই সময়ে তারা নিচে থেকে স্যারকে হুমকি দিচ্ছিল, কাম্পাসে পুলিশ কেন? পুলিশ টিয়ার ছুড়ল, গুলি চালাল তখন তিনি (উপাচার্য) কোথায় ছিলেন?
এ সব বলে হুমকি দিচ্ছিল। তখন আমরা স্যারকে বলি, স্যার আপনি উপরে চলেন, এখানে থাকলে হামলার শিকার হতে পারেন। এর পরে স্যারকে আমরা উপরে নিয়ে গিয়ে একটা রুমে বসালাম।’
‘তখন ওদের ১৫/ ২০ জনের এরকটা গ্রুপ উপরে উঠে আসে। অধিকাংশরই মুখ গামছা বা মাস্ক দিয়ে ঢাকা ছিল। নিচে ভাঙচুর চলছিল। সব কিছু ভাঙচুর করতে ওদের খুব বেশি সময় লাগেনি। হয়তো বা সর্বোচ্চ ১৫/২০ মিনিট। এ সময় তারা স্যারকে বারবার একই কথা বলে চার্জ করছিল। আর ওরা সিসিটিভি ফুটেজের সার্ভার খুঁজছিল। একটা সময়ে তারা সেটা পেয়ে যায়। তখন স্যারকে মারতে আসছিল কয়েকজন, আমরা যেভাবে পারি তাদের ঠেকাচ্ছিলাম। এরপর তাদের অনেকে চলে যাচ্ছিল। আমরা তখন স্যারকে একটা বলয় তৈরি কররে নিচে নিয়ে আসি। তখনও হামলাকারীদের কেউ কেউ ছিল। নিচে আনার পরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা একজন দুজন করে আসতে শুরু করে। এ সময় নানক সাহেব এসে পড়েন। আর নানক আসার পরে ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারিও আসে। তখন প্রধানমন্ত্রী ফোন দেন স্যারকে,’ বলেন অপু।
বাসভবনের ভেতরে ভাঙচুর চালায় হামলাকারীরা। ছবি: প্রিয়.কম
দ্বিতীয় গ্রুপ ছাত্রলীগ
উপাচার্যকে রক্ষা করতে যাওয়া দ্বিতীয় গ্রুপটি ছিল ছাত্রলীগের। রাত ১টা ৫০ মিনিটের দিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেখানে যান। তারা আসার আগেই ভাঙচুর পর্ব শেষ হয়ে হয়। এই নিয়ে ছাত্রলীগ সংবাদ সম্মেলন করে একাধিকবার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে।
তৃতীয় গ্রুপ ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ
উপাচার্যকে বাঁচাতে যাওয়া তৃতীয় গ্রুপটি ছিল ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী সে সময়ে উপস্থিত হন মেইন গেটের সামনে। তাদের হাতে ছিল রড, হকিস্টিক ও লাঠি। একটি ছবিতে ঢাকা কলেজের টি-শার্ট পড়া একজনকে অস্ত্র হাতে ভিসির বাসভবনের গেট দিয়ে ঢুকতে দেখা গেছে।
ছাত্রলীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছেন, ওই সময় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের অনেকে ছিল। কারণ তারা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যদি কোথাও কোনো বিপদে পড়েন সেখানে তারা থাকবেই বলে দাবি তার।
মাথায় হেলমেট পরে উপাচার্য ভবনের গেটের দিকে যাচ্ছেন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের একজন। তার হাতে রডজাতীয় কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। ছবিটি ধরা পড়ে এটিএন বাংলার ক্যামেরায়
চতুর্থ গ্রুপ ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী এবং ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীদের অনেকেই এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তাদের দাবিও একই। তারা বলছেন, যেহেতু ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি সে সময় ক্যাম্পাসে ছিল, তাই তাদের সঙ্গে মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে ছিলেন।
পঞ্চম গ্রুপটি জাহাঙ্গীর কবির নানকের
উপাচার্যকে বাঁচাতে যাওয়া পঞ্চম গ্রুপটি ছিল ঢাকা মহানগরের মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকার বিভিন্ন নেতাকর্মীদের। তারা জাহাঙ্গীর কবির নানকের সঙ্গে ভিসির বাসায় উপস্থিত হয়েছিলেন। রাত ১টা ৫৫ মিনিটের দিকে সেখানে যান তারা।
ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একজন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমাদের বাইরে থেকে ভেতরে যেতে বেশ কয়েকজন যুবক বাধা দেয়। তখন তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা জানান যে, তারা আদাবর এলাকার নেতাকর্মী; নানকের সাথে এখানে এসেছেন।’
নানকের ফোন পেয়ে নেতাদের সঙ্গে নিয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি সোহাগ সেখানে রাত ২টার দিকে উপস্থিত হন।
ষষ্ঠ গ্রুপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ
হামলার সময়ে তারা কাম্পাসের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভিসির বাসভবনের গেটে যান। এরপর তারা মূল গেটের সামনে থাকা অনান্যদের সরিয়ে দেন। তখনই তাদের সঙ্গে কিছু শিক্ষার্থীর ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
ছাত্রলীগ নেতারা করছেন অভিযোগ
উপাচার্য ভবনে হামলাকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী কিছু নেতাকর্মীরা জড়িত বলে অভিযোগ উঠছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেওয়া ও ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করা বেশ কয়েকজন এমন অভিযোগ করেছেন।
ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘প্রথমে আমি একজন ছাত্র। তাই ছাত্রদের সাথে আন্দোলনে অংশ নিই। কিন্তু ছাত্রলীগ যখন সেই সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপরে হামলা চালাল। আমি তখনই দল থেকে পদত্যাগ করি।’
ভিসির বাসভবনে হামলার রাতের বর্ণনা দিয়ে ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘পুলিশের টিয়ারশেলের আঘাতে আমি জ্ঞান হারিয়ে চারুকলার ভেতরে পড়ে ছিলাম। সেখান থেকে আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। হামলার সময় বাইরের কেউ এসে এই হামলা চালিয়েছে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কেউই ভিসি স্যারের বাসভবনে হাত দিবে না।’
ছাত্রলীগের রাজনীতি করা এ শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের ওপরে মহানগর ছাত্রলীগ দিয়ে হামলা চালানো হয়। কাজেই এটা স্পষ্ট যে ভিসি স্যারের ভবনেও মহানগর ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে। আর তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাদের নির্দেশে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগও এই হামলায় অংশ নেয়। সেটার অনেক প্রত্যক্ষ সাক্ষী রয়েছে। সেসময়ে ঢাকা কলেজের টি-শার্ট পড়া একজনকে অস্ত্র হাতে ভিসির বাসভবনের গেটে হামলা চালাতে দেখা গেছে।’
নাম না প্রকাশের শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আরেক সাবেক নেতা একই অভিযোগ করেন।
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতা বলেন, ‘এটা সন্দেহের মধ্যে রাখা যেতে পারে। কিন্তু সুস্পষ্টভাবে তাদের দায়ী করার কোনো এখতিয়ার আমাদের নেই। সন্দেহ হতে পারে দুইটা কারণে, প্রথমত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের মতো একটা জায়গায় রাতের অন্ধকারে কেউ বা কারা হামলা চালিয়ে গেল, কেউ চিনতে পারল না–বিষয়টা অভাবনীয়। এটা না হলে বলতে হবে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কোথাও কোনো অবস্থান নাই। যে কোনো একটা স্বীকার করতে হবে।’
‘ভিসির বাসার গেট ভাঙতে মোটামুটি ১৫ মিনিট সময় লেগেছে। এটা (খবর) দ্রুত পুরো ক্যাম্পাস ছড়িয়ে পড়ার কথা। পুরো হামলা শেষ করতে হামকাকারীরা যথেষ্ট সময় পেয়েছে। এর মধ্যে একজনও কোনো হল থেকে বা অন্য কোথা থেকে এলো না? এটা কী আসলে ভাবার মতো বিষয় না?, প্রশ্ন রাখেন ছাত্রলীগের ওই নেতা।
কোথায় ছিল ছাত্রলীগ
ভিসির ভবনে হামলা চলাকালে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কোথায় ছিলেন–তা নিয়ে নানা ধরনের রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে বলেছেন, তারা মল চত্বরে ছিলেন। আবার অনেকে বলছেন, ক্যাম্পাসের ভেতরে ছিলেন।
প্রশ্ন উঠেছে, মল চত্বর হোক বা ক্যাম্পাস, তা তো খুব কাছেই। তবু কেন ভিসির বাসায় হামলার সময় তারা দ্রুত পৌঁছাতে পারেনি?
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, মাত্র ১০/১২ জন ছাত্রলীগের নেতা প্রথমে ভিসিকে বাঁচাতে ভেতরে যান। ততক্ষণে হামলাকারীদের অনেকে পালিয়েছে। আর ভিসিকেও নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-অ্যাপায়ন সম্পাদক আরিফুজ্জামান ইমরান প্রিয়.কমকে বলেন, ‘ভিসি স্যারের বাসায় হামলার সময়ে আমরা কেন্দ্রীয় নেতারা নানক স্যারের সাথে শাহবাগ মোড়ে একটি সংবাদ সম্মেলনে ছিলাম। আমরা আন্দোলনকারীদের বুঝাচ্ছিলাম যে, আবু বকর নামের সেই ছেলেটি মারা যায়নি, বেঁচে আছে। এমন সময়ে আমরা ভিসির বাসায় হামলার খবর পেয়ে ওই দিকে দৌড়ে যাই। এ সময়ে কেউ হয়তো একটু আগে পৌঁছে ছিল কেউবা একটু পরে।’
ছাত্রলীগ উপস্থিত হওয়ার পরে গুলিও চলেছিল
হামলার পরে উপাচার্যকে বাঁচাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাসহ অনেকে ছুটে যান। তখন ঢাকা কলেজ, মহানগর ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেখানে হাজির হন। তারা উপস্থিত হওয়ার পরেই অর্থাৎ রাত ২টা ০৫ মিনিট বা ১০ মিনিটের দিকে শুরু হয় গুলি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, প্রথমে ৭/৮ রাউন্ড গুলি হয়। এর পরেই ব্রাশ ফায়ারের মতো গুলি শুরু হয়। তখনো পুলিশ সেখানে পৌঁছায়নি। কে বা কারা এভাবে গুলি ছুড়েছে তা কেউই দেখেনি, শুধু শব্দ শুনেছেন। গুলির শব্দ বন্ধ হওয়ার পরে পুলিশ চলে আসে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ছাত্রলীগের উপস্থিতিতেই এই গুলি চালানো হয়।
ছবিতে দেখুন কারা হামলাকারী
উপাচার্য ভবনে মূল হামলায় অংশ নেয় ২০ থেকে ৩০ জন। তাদের মুখ কাপড়, গামছা ও মাস্ক দিয়ে ঢাকা ছিল। আর অন্যরা ছিল তাদের সহযোগী।
মুখ বেঁধে হামলায় অংশ নেওয়া কয়েকজনের ও হামলার সময়ের কিছু ছবি রয়েছে প্রিয়.কম-এর হাতে।
প্রথম ছবিতে (সংবাদের লিড ছবি) দেখা যাচ্ছে, ভিসির বাসভবনের দ্বিতীয় তলায় কয়েকজন মিলে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছেন। এদের মধ্যে বামে সাদা কালো রংয়ের টি-শার্ট পড়া এক যুবক কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখে একটি গামছা বাধা রয়েছে। ঠিক তার পিছনেই লাল ও ছাই রঙের টি-শার্ট পরা আরও দুজন দাঁড়ানো।
আর ছবির ডান পাশে গেবাটিন প্যান্ট পরা, কিন্ত খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক যুবক। তারও মুখে একটি কাপড় বাঁধা ছিল যেটা খুলে গিয়ে কিছুটা গলার দিকে নেমে এসেছে। ঠিক তার পেছনেই উঁচু কোনো একটি জিনিসের ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কালো গেঞ্জি ও জিন্স প্যান্ট পরা আরও এক যুবক।
দ্বিতীয় ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ভিসির বাসভবন থেকে জিনিসপত্র বের করে এনে গেটের পাশে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছেন কয়েকজন। এখানে অনেকের মুখ খোলা থাকলেও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ও কমলা রঙের গেঞ্জি পরা একজন গেটে দাঁড়িয়ে আছেন, তবে তার মুখে কালো কাপড় বাঁধা ছিল।
তৃতীয় ছবিতে দেখা যাচ্ছে, গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন দুজন। এদের একজনের পরনে জিন্স প্যান্ট ও গোল গলার সাদা গেঞ্জি। তার হাতে একটি লাঠি রয়েছে। আর তার ঠিক পিছনেই আবছা ছবিতে একজনকে মুখ বাঁধা অবস্থায় বের হতে দেখা যাচ্ছে।
চতুর্থ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ভিসির বাসার একটি রুমের সোফা ও টি-টেবিল ভেঙে ফেলা হয়েছে। আর সেই টি-টেবিলের পাশেই পায়ে স্যান্ডেল ও গায়ে গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে আছে একজন। তার হাতে একটি বাঁশের লাঠি দেখা যাচ্ছে। তবে তার মুখটি দেখা যাচ্ছে না।
‘হামলার সময় তিন ভাগ হয়ে যাই’
হামলার পর থেকেই উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলে আসছেন, হামলাকারীরা বহিরাগত। সেই রাতের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘ঘটনার শুরুর সময়ে আমার মেয়ে, আমার স্ত্রী, এদের অবস্থা দেখে আমি…। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে... আমার মেয়ে গা-মোছ করে দেয়। আমার স্ত্রী দোয়া পড়ে গায়ে ফুঁ দেয়।’
‘১টা ২৫ মিনিটের দিকে এরা বাসা থেকে নামার জন্য পথঘাট খুঁজতেছে। এরপর আমরা তিনভাগ হয়ে যাই। আমার ছেলে একা একদিকে গেল, আমার স্ত্রী আর মেয়ে একসাথে গেছে, আর আমি আলাদা একা। আর আমি বাড়ির স্টাফদের তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেই, ১০টা সাড়ে ১০টার পরে আর রাখি না। তাই অনেকেই চলে যায় সে রাতে। মাত্র দুজন না তিনজন ছিল, তার মধ্যেও সবচেয়ে সিনিয়র লোকটা মার খাইছে, তার মোবাইলটাও নিয়ে গেছে,’ বলেন ভিসি।
ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘অপরাধীদের সনাক্ত করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হামলাকারীরা প্রথমেই সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙছে। এর পরেই লাইট নিভে অন্ধকার হয়ে গেল। সাংবাদিক সংগঠনের প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি সেসময়ে উপস্থিত ছিল, তারা উপস্থিত থাকতেই হামকাকারীর একজন বলতেছিল সিসিটিভি ক্যামেরার সার্ভারটা কোথায়। সুতরাং বোঝা গেল এটা একটা অর্গানাইজড ক্রাইম।’
হামলাকারী কারা হতে পারে? জানতে চাইলে ভিসি বলেন, ‘স্পষ্টই এখানে বিশ্ববিদ্যালের কোনো শিক্ষার্থী নেই। তবে যদি কারো প্রমাণ মেলে সেটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য। এই ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকবে এটা আমাদের চিন্তাও আসে না। কোনো নিরপরাধ শিক্ষার্থী যেন হয়রানির শিকার না হয়, সেটা স্পষ্ট বলা আছে। তবে দুর্বৃত্তদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।’
'কিরে ভাই এগুলো কী? কেউ কোনো উত্তর দেয় না'
হামলার ঘটনা নিয়ে আন্দোলনকারী নেতা রাশেদ খান প্রিয়.কমকে বলেন, ‘হামলার ঘটনার সময়ে আমরা ছিলাম চারুকলার মধ্যে। সেখানেও পুলিশ যখন টিয়ার গ্যাস ছোড়ে, তখন আমরা তারকাঁটার দেয়াল টপকিয়ে বিজনেস ফ্যাকাল্টির মধ্যে যাই। এর পর ক্যাম্পাস থেকেই দেখি, ভিসির বাসভবনে আগুন জ্বলছে। এটা দেখেই আমরা এগিয়ে যাই, দেখি আগুন কারা জ্বালিয়েছে? সেখানে যখন আমরা ভিতরে যাই দেখি সব জায়গায় চেয়ার টেবিল এনে সব পোড়াচ্ছে। আমরা তখন যারা ছিলাম, আমরা বলি কিরে ভাই এগুলো কী? এগুলো কারা করছে? কেউ কোনো উত্তর দেয় না। এরপর আমরা দাঁড়াইয়া কয়েকজনকে বলি, এগুলো করছেন কেন? আমাদের আন্দোলন তো সহিংস নয়, এমন কোনো নির্দেশনাও নাই। তখন কয়েকজন বলে, আপনারা এখানে থাইকেন না। থাকলে আপনাদেরই মার দেবে। এর পর দেখি অনেক বহিরাগতরা অস্ত্র নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। তখন আমরা চলে আসি।’
কোনো আন্দোলনকারী ভিসির বাসায় হামলা করতে ভেতরে প্রবেশ করেছিল কি–এমন প্রশ্নের জবাবে রাশেদ খান বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি অবগত নই। কারণ কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে এমন কোনো নির্দেশনা ছিল না। কেউ কেউ দেখতে গিয়েছিল। দু-একজন প্রবেশ করে থাকলেও কেউ ভাঙচুর করতে যায় নাই। তাদের নিষেধ করতে গিয়েছে। যারা হামলা চালিয়েছে এরা সবাই বহিরাগত।’
অন্যদের ভাষ্য
হামলাকারীদের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান জানান, এই ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্ত চলছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগকে পাওয়া যায়নি।
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন