সরকারি চাকরিতে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে দুই শতাধিক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করেছেন গোয়েন্দারা। ওইসব ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ আন্দোলনকারী গোটা ছাত্রসমাজের মধ্যে যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়া হয় বলে মনে করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এসব অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে আইসিটি অ্যাক্টে মামলা হচ্ছে। একইসঙ্গে নিবিড়ভাবে তদন্ত করছে পুলিশের সাইবার ক্রাইম টিম। তদন্তে দোষী প্রমাণিতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা।
ওই কর্মকর্তারা জানান, শনাক্ত করা ফেসবুক অ্যাকাউন্টগুলো থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রদের তুমুল আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে এক ছাত্রের মারা যাওয়া, কবি সুফিয়া কামাল হলের এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দেয়ার গুজব ওঠানো হয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় ও দলের পৃথক তদন্তে ওই ছাত্রী নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন।
এই গোয়েন্দা কর্মর্কতারা মনে করেন, বিতর্কিত ও ভুয়া স্ট্যাটাস দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার দিয়ে ভাইরাল করে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা হয়। যার প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের (ভিসি) বাসায় ঘটে নারকীয় হামলা। একইভাবে ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগে এক ছাত্রলীগ নেত্রীর ওপর চালানো হয় মধ্যযুগীয় বিচার। ফেসবুকে অপপ্রচারকারীদের অন্য কোনো উদ্দেশ ছিল কিনা সেটিও খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ৮ এপ্রিল রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোটা সংস্কারে দাবিতে আন্দোলনকারী ছাত্রদের সঙ্গে
সামান্য সংঘর্ষ ঘটে। সেখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ও ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ জলকামান ও হালকা টিয়ারশেল ব্যবহার করে। অথচ ওইদিন রাতেই কতিপয় ফেসবুক ব্যবহারকারী পুলিশের গুলিতে এক ছাত্র নিহত হয়েছে স্ট্যাটাস দেয়। পরে সেগুলো ভাইরাল করার মাধ্যমে সাধারণ ছাত্রদের পরিকল্পিতভাবে উত্তেজিত করে তোলে।
তারা জানান, অথচ ৮ এপ্রিল রাতেই ফেসবুক লাইভে ও গণমাধ্যমের কাছে মারা যাননি বলে সেই ছাত্র নিজেই জানান। ওই মিথ্যা প্রোপাগান্ডার কারণেই ঢাবির ভিসির বাসায় দুর্বৃত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের জঘন্যতম হামলা চালায়। এসব গুজব ছড়ানো আইডিগুলো আমরা ইতিমধ্যেই শনাক্ত করেছি। সেগুলো নিয়ে তদন্ত চলছে। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, একইভাবে ৯ এপ্রিল গভীর রাতে দাবি করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জানান ইশা আন্দোলনকারী এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছে। এমনটা গুজব ছড়িয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন কতিপয় অপপ্রচারকারী। সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে ভিডিও শেয়ার দিয়ে ভাইরাল করা হয়। এর ফলে উত্তেজিত হয়ে মধ্যরাতে ঢাবির অন্য হলগুলোর ছাত্রছাত্রীরা সেখানে ছুটে যান।
সেখানে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতা ইশাকে মারধরের পর গলায় জুতার মালা পরানোর মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়। অথচ যাকে ঘিরে এই অপপ্রচার ওই হল শাখার ছাত্রলীগের সহসভাপতি মোর্শেদা আক্তার নিজেও রগ কাটার ঘটনার কথা কোথাও বলেননি। অথচ মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের চরম ক্ষোভের মুখে ইফফাত জাহান ইশাকে রাতেই হল, দল ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও ঢাবি প্রশাসন।
ওই পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, হয়তো বিশেষ কোনো উদ্দেশ নিয়ে কিংবা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে সেই রাতে ফেসবুকে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে নেপথ্যে কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীও থাকতে পারে। পুলিশ সংশ্লিষ্ট ফেসবুক আইডিগুলো শনাক্ত করেছে। এদের কারো কারো ফেসবুক স্ট্যাটাস ঘেঁটে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য বলেও প্রতীয়মান হচ্ছে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনকে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে।
তারা বলেন, কবি সুফিয়া কামাল হলের সেই ছাত্রী ইশা নিজ দলের তদন্তে দু’দিন পরই নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। তাই তার ওপর বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। আর একই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল, তাতেও নিরপরাধ প্রমাণিত হয়েছেন ইশা। তাই গতকাল বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই ছাত্রীর বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসার হামলা মামলার তদন্তে অগ্রগতি রয়েছে জানিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আশপাশ এলাকার সিসি টিভির ভিডিও ফুটেজ ঘেঁটে কয়েক দুর্বৃত্তকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। আরো তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ছাত্রের বক্তব্যও পাওয়া গেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন সংক্রান্ত অন্য তিনটি মামলার তদন্তও এগিয়ে চলছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (অপরাধ) অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ নাজমুল আলম জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় যারা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিল, তাদের আবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। এ পর্যন্ত অন্তত দুইশ’ ফেসবুক আইডি পুলিশ শনাক্ত করেছে। এ নিয়ে তদন্ত করছে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট।
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন