একটি অডিওতে ডিআইজি মিজান একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলের সংবাদ পাঠিকাকে এভাবেই বলছিলেন, ‘শুধু একটু বাসা থেকে বাইর হয়ে দেখ। তুই সাম্বাদিক (সাংবাদিক)... (গালি দিয়ে) বাচ্চাদের বলবি আমি থ্রেট করছি। আমাকে সাসপেন্ড করাইছিস না?’
ডিআইজি মিজান সংবাদ পাঠিকাকে হুমকি দিয়ে আরো বলেন, ‘অভিযোগ প্রত্যাহার করে মিডিয়ায় প্রকাশ্যে ক্ষমা না চাইলে তোকে সপরিবারে মেরে ফেলব। আমার কথা না শুনলে তোকে ৬৪ টুকরা করে ৬৪ জেলায় পাঠানো হবে। তোর মাথাটা রাখা হবে জিরো পয়েন্টে।
যা হয় হবে। রেকর্ড কইরা রাখ। আর আমার সঙ্গে থাকলে কোনো ক্ষতি হবে না। আমিই তোকে শেল্টার দেব।’বেসরকারি টেলিভিশনের সেই সংবাদ পাঠিকাকে সম্প্রতি এভাবেই হত্যার হুমকি ও অনৈতিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন ডিএমপি থেকে প্রত্যাহার হওয়া ডিআইজি মিজানুর রহমান।
একজন পুলিশ কর্মকর্তার এধরণের হুমকি এবং সাংবাদিকদের গালি দেয়ার বিষয়টি এখন আলোচানায় আসছে ঘুরে ফিরে। প্রশ্ন উঠেছে তার খুটির জোর কোথায়? কেন তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না?
এ ঘটনা মিডিয়ায় প্রকাশের সমস্ত দায় সংবাদ পাঠিকাকে নিতে হবে বলে টেলিফোনে প্রতিদিন হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছেন ক্ষমতাধর এই পুলিশ কর্মকর্তা।
নারী কেলেঙ্কারিত অভিযুক্ত ডিআইজি মিজানের অব্যাহত হুমকির মুখে একরকম গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে একটি পরিবার। অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে নিয়মিত হুমকি, পুলিশ পাঠিয়ে হেনস্তাসহ নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে পরিবারটিকে। এদিকে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে গঠিত পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিলেও এখনো কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
এমনকি চাপ প্রয়োগ করে একটি শোরুমের মালিককে দিয়ে সংবাদ উপস্থাপিকার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। এরপর বাসায় পুলিশ পাঠিয়ে করা হয় হয়রানি।
এ বিষয়ে শোরুমের একজন কর্মচারী সময় সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ডিআইজি মিজান তার লোকজন নিয়ে শোরুমে এসে জোরপূর্বক জিডি করায়।
ওই শোরুম মালিক বলেন, 'অনেক বুঝিয়েছিলাম যে, ভাই জীবনে অনেক কিছুই ঘটে। এসব ভুলে যান। আমারে আরও উল্টা ঝাড়ি দেয়।'
এদিকে ভুক্তভোগী সংবাদ পাঠিকা সময় সংবাদমাধ্যমকে জানান, ডিআইজি মিজানের অব্যাহত হুমকির ফলে তার পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কে রয়েছেন। নিজ বাসায় এক রকম বন্দী জীবন কাটছে তাদের।
পরিবারের নিরাপত্তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন ভুক্তভোগীর স্বামী।তিনি বলেন, 'কতটা সাহস থাকলে সে এত কথা বলে যেতে পারে। আমরা এখনও তার ভায়ে ঘরবন্দী হয়ে আছি।'
বিভিন্ন সময় মিজানের পাঠানো এসএমএসের স্ক্রিনসর্ট ও রেকর্ড করা ফোনালাপসহ ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটে একটি লিখিত অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগী নারী। তবে এ ব্যাপারে বিমানবন্দর থানায় জিডি করতে গেলে পুলিশ নিতে রাজি হয়নি।
বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করা ডিআইজি মিজানের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
৯ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার পদ থেকে প্রত্যাহার করা হলেও বর্তমানে পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত আছেন মিজানুর রহমান। এদিকে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে গঠিত পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটি ২৮ ফেব্রুয়ারি ডিআইজি মিজানকে অভিযুক্ত করে তাদের রিপোর্ট আইজিপির কাছে জমা দেয়। পরে সেই রিপোর্ট পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে। কিন্তু বেশ কয়েকদিন পার হয়ে গেলেও মন্ত্রণালয় এখনো কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি তার বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
গত ১০ এপ্রিল বিমানবন্দর থানায় দায়ের করা অভিযোগে সংবাদ পাঠিকা বলেন, পুলিশ সদর দফতরে প্রত্যাহার হওয়া ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মিজানুর রহমান গত ২৯ মার্চ দুপুর আনুমানিক ২টার দিকে ০১৭৯৪২০২০২০ নম্বর থেকে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে ফোন করে সপরিবারে প্রাণনাশের হুমকি দেন। সেই সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনসহ গণমাধ্যমের কর্মীদেরও জীবননাশের হুমকি দেয়া হয়। তিনি যদি বাসা থেকে বের হন বা অফিসে যান তাহলে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করারও হুমকি দেন।
এমনকি অশ্লীল ছবি তৈরি করে প্রচারেরও হুমকি দেন ডিআইজি মিজান। ওই হুমকি দেয়ার দিন রাতেই ‘দেশি মাল’ (ইংরেজিতে) নামে একটি ফেসবুক পেজ অ্যাকাউন্টের তথ্য পান তিনি।
অডিওতে ভয়ংকর হুংকার :
এদিকে একটি বিশেষ স্থান থেকে বেপরোয়া ডিআইজি মিজানুর রহমানের হুমকি-ধমকি সংক্রান্ত ফোন কলের বেশ কয়েকটি অডিও পাওয়া যায়। ফোনালাপের অডিওতে ডিআইজি মিজানকে ভয়ংকরভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে শোনা যায়।
একটি অডিওতে ডিআইজি মিজান ওই সংবাদ পাঠিকাকে বলতে শোনা যায়, ‘তোর জামাইরে ঘর থেকে বাইর হতে বল। পোলাপান রেডি আছে। সব রেডি আছে। তোকে মাইরা ফালামু। কোন... পোলা তোরে বাঁচায় আমি দেখুম।
এ সময় ওপাশে অঝোরে কাঁদছেন ওই সংবাদ পাঠিকা। ডিআইজি মিজান বলছেন, যেখানেই যাবি তোর নুড (অশ্লীল) ছবি পাঠানো হবে। তুই আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস করছিস।’
এর জবাবে সংবাদ পাঠিকা বলছেন, ‘আমি কিছুই করিনি। আমার ছেলের কসম খাইয়া বলছি, আমি কিছুই করিনি।’ আবার হুমকি দিয়ে মিজান বলেন, ‘শুধু একটু বাসা থেকে বাইর হয়ে দেখ। তুই সাম্বাদিক (সাংবাদিক)... (গালি দিয়ে) বাচ্চাদের বলবি আমি থ্রেট করছি। আমাকে সাসপেন্ড করাইছিস না?’
এরপর... গালি দিয়ে বলেন, ‘তোকে অ্যারেস্ট করতে এখন ভাটারা থানার পুলিশ যাচ্ছে। সার্চ ওয়ারেন্ট হইছে। আসামি তুই আর তোর জামাই। তুই আমার সাথে চ্যালেঞ্জ দিবি? আমার সাথে চ্যালেঞ্জ দিয়ে তুই আমার চাকরি খাইছিস। মিডিয়ায় সবকিছু দিছিস তুই।....
অডিওতে মিজান আরো বলেন, ‘তোর জামাইরে বের হতে বল। টুকরা টুকরা করব। আর তোরে করব ৬৪ জেলায় ৬৪ টুকরা।... (প্রকাশযোগ্য নয়)। আমার কথার বাইরে যদি চলস তোকে আমি মাইরা ফালামু।’
এরপর বলেন, ‘এখন তুই আত্মহত্যা করবি। না হলে তোরে মাইরা ফালামু আমি। পৃথিবীর কোনো শক্তি নাই তোকে বাঁচায়। তোরে পাহারা দিতে ১০টা মোটরসাইকেল থাকবে।
অডিওর একটি অংশে মিজান আবারও উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, ‘তোকে তিনশ ফিটে নিয়ে ইজ্জত হরণ করতে চাইছি? মানুষকে জড়ো করে বলছিস না? যেদিন মানুষ জড়ো করে অপমান করছিস এর রেজাল্ট আমি মিজান যদি বেঁচে থাকি, আমি কুত্তার বাচ্চা না হই, আমার বাবা যদি আমাকে পয়দা করে থাকে, তাহলে তোরে আমি দেখাব। তুই যদি আমার... ছিঁড়তে পারিস।
আমাকে সাসপেন্ড করাইছিস না? কর। বাঁচতে চাইলে মিডিয়ায় যাইয়া বলবি, আমি ভুল করছি। উনাকে অপমান করে আমি ভুল করছি। এই বলে মিডিয়ায় স্টেটমেন্ট দিবি। না হলে তোর জামাই, সংসারসহ সব ছিন্নভিন্ন কইরা ফালামু আমি।
সাহস থাকলে বের হয়ে আয়। আমার লোকজন আছে, আমিও আছি এখন। আমার চাকরি তো নাই এখন। নুড ছবি ইউটিউবে যাবে, ফেসবুকে যাবে, সব মিডিয়ায় যাবে। আর আমার সঙ্গে ভালো হয়ে চল, ভদ্র হয়ে চল, কিচ্ছু হবে না তোর। তোকে শেল্টার আমি মিজান দেব।’ জবাবে সংবাদ পাঠিকা বলেন, ‘না আমি কিচ্ছু করিনি। কোনো অভিযোগ করিনি।’ এবার মিজান বলেন, ‘কেন? প্রগতি সরণিতে লোকজন ডেকে বলছিলি না?’ ...
অভিযোগের বিষয়ে ডিআইজি মিজানের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন