নিম্নমানের মুদ্রণ ও সংরক্ষণজনিত ত্রুটির কারণে দেশীয় ভেন্ডার প্রতিষ্ঠান স্মার্ট টেকনোলজিস বিডির মুদ্রিত ৭০ লাখ জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অকেজো হয়ে পড়েছে। মাঠপর্যায়ে বিতরণ করতে গিয়ে বিতরণকারী কর্মকর্তা ও কার্ডধারী নাগরিকদের কাছে কার্ডগুলোর এই বিবর্ণ রূপ ধরা পড়ে।
কাজটি এতই নিম্নমানের হয়েছে, যা দেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার উপক্রম। এরই মধ্যে মাঠ পর্যায়ে পাঠানো মুদ্রিত জাতীয় পরিচয়পত্র বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গঠন করা হয়েছে একাধিক তদন্ত কমিটি।
এনআইডি কর্মকর্তারা জানান, কাগজে মুদ্রিত লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্র মুদ্রণে গোঁজামিল ও দায়সারা কাজ সম্পন্ন করে বিল বাগিয়ে নিতে চেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর সম্ভব করতে পারেনি প্রতারক প্রতিষ্ঠান স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ। এর আগে ফ্রান্সের ওবার্থু কোম্পানির স্মার্ট কার্ড মুদ্রণে ব্যর্থতার কারণে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্প থেকে সরে যায়। পরে সরকারের অর্থায়নে স্মার্টকার্ড মুদ্রণ কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ১০ কোটি ৪১ লাখ ভোটার রয়েছে। লক্ষ্য ছিল, সব ভোটারের হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দেয়া। প্রথমে আইডিয়া প্রকল্প-১ এর অধীনে ৯ কোটি ভোটারকে এবং আইডিয়া প্রকল্প-২ এর আওতায় অবশিষ্ট ভোটারকে স্মার্ট পরিচয়পত্র দেয়ার চিন্তা ছিল ইসির।
এ লক্ষ্যে ২০১২ সাল পরবর্তী সব নিবন্ধিত ভোটারকে, যার সংখ্যা ৯৩ লাখ ভোটারের নরমাল জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু স্মার্টকার্ড বিতরণে প্রথম ধাপের কার্যক্রমে ধীরগতির কারণে পরিচয়পত্র না পাওয়া ৯৩ লাখ ভোটারকে নরমাল পরিচয়পত্র দিতে গত বছরের ৩১ অক্টোবর কমিশনের ১২তম সভায় সিদ্ধান্ত হয়। এ মোতাবেক দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ কাজের জন্য দরপত্র জমার শেষ দিন ছিল গত বছরের ৮ নভেম্বর।
কাজটি পেতে ক্রিয়েটিভ বাংলাদেশ, এম এন মোল্লিক অ্যান্ড কোম্পানি এবং স্মার্ট টেকনোলজিস (বিডি) লিমিটেড দরপত্রে অংশ নেয়। এর মধ্যে ক্রিয়েটিভ বাংলাদেশ ছিল সর্বনিম্ন দরদাতা, যার টাকার পরিমাণ ৫ কোটি ৩১ লাখ ৮৪ হাজার ৭৬১ টাকা, দ্বিতীয় এম এন মোল্লিক অ্যান্ড কোম্পানির ৭ কোটি ৮৩ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা এবং স্মার্ট টেকনোলজিসের ৮ কোটি ৯৬ লাখ ২৮ হাজার ৪০০ টাকা।
তথ্য পর্যালোচনায় জানা গেছে, সর্বনিম্ন দরদাতা থেকে ৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা বেশি দেখানো প্রতিষ্ঠান স্মার্ট টেকনোলজিসকে নিয়মনীতির তোয়াক্কা ছাড়াই কাজটি দেয়া হয়। কাজটি পেয়েই অফিসের বড় বাবু সেজে বসে প্রতিষ্ঠানটি। মনের মাধুরি মিশিয়ে কার্ড মুদ্রণ করতে থাকে।
জানা যায়, ৯৩ লাখ কার্ডের মধ্যে ৭০ লাখ মুদ্রণ সম্পন্ন করে কর্তৃপক্ষকে তা বুঝিয়েও দেয়। এমনকি কমিশন সেগুলো দেশের ৭ জেলার সব উপজেলায় বিতরণের জন্য পাঠায়, যা কমিশনের ১৭তম সভার কার্যপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
বিতরণ করতে গিয়ে মাঠ পর্যায় থেকে অভিযোগ পেয়ে তড়িঘড়ি চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আইডিয়া প্রকল্পে উপপ্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল হাইকে আহ্বায়ক এবং আইডিয়া প্রকল্পের সংযুক্ত কর্মকর্তা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আবদুল্লা নাসের, এনআইডির সহকারী পরিচালক এ এস এম ইকবাল হাসান ও আইডিয়া প্রকল্পের জুনিয়র কমিউনিকেশন্স কনসালট্যান্ট হোসাইন মোহাম্মদ আশিকুর রহমানকে সদস্য করা হয়।
কমিটি ভেন্ডার কর্তৃক মুদ্রণ কার্য পর্যবেক্ষণ, মুদ্রিত কার্ডের মান যাচাই ও ভোটার এলাকাভিত্তিক প্যাকিংসহ কার্ড বুঝে নেয়ার জন্য এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বাকি ২৩ লাখ কার্ড মুদ্রণ কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করে। পর্যবেক্ষণে কমিটি ৮ ধরনের ত্রুটি খুঁজে পায়। এর মধ্যে কার্ড মুদ্রণে রিফিল কালি ব্যবহার, কার্ড সঠিকভাবে কাটিং না করায় অসংখ্য কার্ডে ভোটারের তথ্য কাটা পড়া, লেমিনেটিং করার সময় মেশিনে সঠিকভাবে হিট না দেয়ায় মুদ্রিত কার্ড খুলে যাওয়া, লেমিনেশন না করেই সংরক্ষিত বাক্সে পেপার কার্ড রাখা, একই পাউচে একাধিক কার্ড সংরক্ষণ করা, পাউচের ভেতরে বাঁকানো কার্ড ঢোকানো এবং এক জেলার বাক্সে অন্য জেলার কার্ড সংরক্ষণ করে স্মার্ট টেকনোলজিস।
এসব অনিয়মের বিষয়ে কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, ভেন্ডার সম্পূর্ণ অযত্ন ও অবহেলায় কার্ড মুদ্রণ ও লেমিনেশন কাজ করেছে। কাজের গুণগতমানের দিক বিবেচনা না করে দায়সারাভাবে কাজ শেষ করার দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। এ ধরনের নিম্নমানের কার্ড গ্রহণ করে যদি মাঠ পর্যায়ে বিতরণের জন্য পাঠানো হয় তাহলে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিড়ম্বনার শিকার হবেন। পাশাপাশি ভোটাররা এ ধরনের কার্ড গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। এ নিয়ে জনমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে, যা কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করবে।
এ ছাড়া কমিটি মুদ্রিত কার্ড মাঠ পর্যায়ে প্রেরণ করা সমীচীন হবে না বলে তাদের মতামত দেন। আইডিয়া প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে জনবল নিয়োগ করে প্রত্যেক ভোটার এলাকাভিত্তিক কার্ডগুলোর মান যাচাই-বাছাই করা সমীচীন বলে কমিটি তাদের মতামতে তুলে ধরেন।
তারা আরো বলেন, নিয়োগ করা জনবলের পারিশ্রমিক ভেন্ডার পরিশোধ করবে। একইসঙ্গে মুদ্রিত কার্ডগুলো পুনরায় মুদ্রণ করে বিতরণের ব্যবস্থা করাই শ্রেয় বলে মতামত দিয়েছে কমিটি।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, স্মার্ট টেকনোলজিস জাতীয় পরিচয়পত্র মুদ্রণের কাজ নি¤œমানের করায় এরই মধ্যে মুদ্রিত কার্ড বিতরণ বন্ধ রাখা হয়েছে। কাজে অনিয়ম তদন্তে প্রথম কমিটির প্রতিবেদন পেয়েছি। এখন দ্বিতীয় আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন