মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত ট্যাংক ও হেলিকপ্টার বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে ভারত। মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর উপর যৌথবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের সময় এই বাহনগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে পাকসেনাদের পরাস্ত করতে যৌথবাহিনীর অংশ হিসেবে ভারতীর সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহার করেছিল উভচর ট্যাংক। আর আকাশ পথে দ্রুত শত্রু ঘায়েল করতে ব্যবহার হয়েছিল এমআই-৪ হেলিকপ্টার।
মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত এ স্মারক দুটি বুধবার (২৫ এপ্রিল) বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছেন ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। বিমানবাহিনীর ঘাঁটি বাশারে আয়োজিত এক হৃদ্যতাপূর্ণ অনুষ্ঠানে তিনি স্মারক দুটি হস্তান্তর করেন।
পিটি-৭৬ মডেলের ট্যাংক দুটি গ্রহণ করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল নাজিম উদ্দিন। আর এমআই-৪ মডেলের কপ্টারটি গ্রহণ করেন সহকারী বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল আবুল বাশার।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা জানান, ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর বাংলাদেশ সফরকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক উপহার দেন। স্মারকগুলোর মধ্যে ছিল- দুটি পিটি-৭৬ ট্যাংক, একটি এমআই-৪ হেলিকপ্টার ও ২৫টি অস্ত্র (পিস্তল, রাইফেল, মেশিন গান, মর্টার, রকেট লঞ্চার)।
এছাড়া অনেক শিল্পকর্ম, ঐতিহাসিক ফটো, অডিও-ভিডিও ক্লিপিং, মানচিত্র, যুদ্ধের দলিল, পত্রিকার ক্লিপিং, মু্ক্তিযুদ্ধভিত্তিক তথ্যচিত্রও ছিল স্মারক উপহারের মধ্যে।
শ্রিংলা বলেন, অধিকাংশ স্মারক বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন ট্যাংক ও কপ্টারের মতো বড় স্মারকগুলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হলো। এগুলো তাদের নিজ নিজ জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য রাখা হবে।
বড় দুটি স্মারকের ব্যাখা দিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, পিটি-৭৬ ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীল আর্মার্ড রেজিমেন্টের হালকা ধরনের উভচর ট্যাংক। যুদ্ধের সময় নদী ও জলাশয় পারাপারে এই ট্যাংকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। গরিবপুরের বিখ্যাত যুদ্ধে এই ট্যাংকগুলোর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। যে যুদ্ধে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত এম-৩৪ শ্যাফে ট্যাংকসমৃদ্ধ পাকবাহিনীর একটি বড় দল পরাজিত হয়েছিল। উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিম ও মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত উভচর ট্যাংক ও এমআই-৪ কপ্টার হস্তান্তর অনুষ্ঠান।
পশ্চিমাঞ্চলে পাকবাহিনীকে পিছু হটাতে এ ট্যাংকগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
অন্যদিকে এমআই-৪ হেলিকপ্টার ভারতীয় বিমাবাহিনীর পরিবহন হেলিকপ্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। পূর্বাঞ্চলে যৌথ বাহিনীর আকাশপথে পরিচালিত অপারেশনের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল এটি। সিলেটকে দ্রুত শত্রুমুক্ত করতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ৪/৫ গুর্খা ব্যাটালিয়নটি এই অপারেশনের জন্য সুরমা নদীর তীরে সিলেটের উপকণ্ঠে অবতরণ করেছিল। আবার ওই হেলিকপ্টারযোগেই ১৯৭১ সনের ৯ ডিসেম্বর প্রমত্তা মেঘনা নদীর চরে অবতরণ করেছিল ৩১১ পদাতিক ব্রিগেড। মেঘনা পারি দিয়ে টানা ৩৬ ঘণ্টায় দখলদার পাকবাহিনীর ওপর ১১০ বার হামলা চালানো হয়েছিল এমআই-৪ হেলিকপ্টার থেকে। যৌথবাহিনীর সেই অভিযান ‘মেঘনা হেলিব্রিজ’ নামে পরিচিত।
হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হস্তান্তর একটি চলমান উদ্যোগ। এর আগে ভারতীর বিমানীবাহিনী একটি হান্টার জেট ফাইটার, একটি ডাকোটা পরিবহন বিমান উপহার দিয়েছে। এছাড়া ভারতীয় সেনাবাহিনী দিয়েছে ছয়টি ৩.৭ হাভিটজার (ছোট কামানবিশেষ) বন্দুক। আর নৌবাহিনী দিয়েছে আইএনএস বিক্রান্ত, যুদ্ধে অংশ নেয়া জাহাজের মডেল এবং সংরক্ষিত ফটো।
ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের এই স্মারকগুলো ভবিষৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। আমরা আপনাদের নিকটতম প্রতিবেশী এবং একটি অভিন্ন ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। ভারতে বাংলাদেশের অনেক সুখ্যাতি আছে। এ দেশের জনগণ যেভাবে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তার প্রশংসা করি আমরা।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার সুযোগ পেয়ে আমরা গর্বিত। স্বাধীনতা সংগ্রাম বাংলাদেশ-ভারতের সৈন্য ও জনগণের সাহস, বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও গৌরবের সাক্ষ্য। এই উত্তরাধিকার এবং চেতনা আগামী দিনগুলোতে দু’দেশের ভবিষৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।
মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত স্মারক হস্তান্তর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন