নাটকীয়ভাবে নিজের নাম পরিবর্তন। এরপর এক নারীকে সাজালেন মা। যাকে সাবরেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ে লিখে নিলেন নিজের মায়ের চারতলা বাড়ি। এই দলিলের মাধ্যমে বাড়ির জমি বন্ধক রেখে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়ে যান ৫৫ লাখ টাকা ঋণ।
অথচ গুণধর ছেলেটি আগেই মাকে গ্যারান্টার দেখিয়ে অন্য একটি ব্যাংকে এই বাড়িটি বন্ধক রেখে তুলে নিয়েছেন ৩ কোটি টাকার ঋণ। সেটি পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে নতুন করে এই পথ বেছে নেন।
এখানেই শেষ নয়, জালিয়াতি করে নেয়া ঋণের দুই কিস্তি পরিশোধের পর সস্ত্রীক লাপাত্তা। পরিচয় গোপন রেখে দেশ ছাড়তে তারা জাতীয় পরিচয়পত্র জাল করেন। সেখানে ছদ্মনাম ধারণ করে এবং সেভাবে তারা পাসপোর্টও তৈরি করেন। এরপর স্ত্রীকে নিয়ে পাড়ি জমান একেবারে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক।
এদিকে ঋণের টাকা না পেয়ে ঋণদাতা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড শক্ত অবস্থান নেয়। রাজধানীর শঙ্কর এলাকার বাড়িটি নিলামে বিক্রির জন্য দখলে নিতে সেখানে সাইনবোর্ড টানাতে যান ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরা।
এমন খবর শুনে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে বড় ছেলে ফয়সাল জামানের এই জালিয়াতি। বলতে গেলে পুরো পরিবারটি এখন নিঃস্ব হতে বসেছে।
চাঞ্চল্যকর জালিয়াতির বিষয়টি বের করে এনেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্ত অনুসন্ধানের প্রধান তথ্য হল- ফারহানা আক্তার নাসিমের বড় ছেলে ফয়সাল জামান ছদ্মনাম আরিফুজ্জামান ধারণ করে এবং তার স্ত্রী সাদিয়া আকন্দের নাম পরিবর্তন করে সাদিয়া জামান সনি উল্লেখ করে এসব জালজালিয়াতি করেন।
তবে পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঋণদাতা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসির সংশ্লিষ্ট কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশ থাকার প্রমাণ মিলেছে। এজন্য তারাও নিশ্চিত আর্থিক সুবিধা নিয়েছে। কেননা তারা যথাযথভাবে যাচাই করে ঋণ দিলে এ জালিয়াতি শুরুতেই ধরা পড়ত।
বাড়ির মালিক ফারহানা আক্তার নাসিম আইডিএলসি-কে সাফ জানিয়ে দেন, আরিফুজ্জামান নামে তার কোনো ছেলে নেই। তাছাড়া তিনি এ নামের কাউকে বাড়িটি লিখেও দেননি। আর ঋণ নেয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
তাছাড়া এ বাড়িটি আরব বাংলাদেশ ব্যাংকে বন্ধক রেখে তার বড় ছেলে ফয়সাল জামানের নামে ২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা নেয়া। কিন্তু আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সংশ্লিষ্টরা এসব বিষয় মানতে রাজি হননি। তারা বাড়িটি নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নেন।
পরে নিজেদের বাড়ি টিকিয়ে রাখতে ফারহানা আক্তার নাসিমের ছোট ছেলে ফাইয়াজ জামান বাদী হয়ে পল্টন থানায় একটি মামলা করেন। আরিফুজ্জামানকে শনাক্ত করতে না পারায় মামলার তদন্তেরও কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। পরে আদালত মামলাটির তদন্তভার পিবিআইকে দেন। অতঃপর পিবিআইর তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
জানা গেছে, ফয়সাল জামান ও ফাইয়াজ জামান দুই ভাই। তাদের বাবার নাম আক্তারুজ্জামান। মোহাম্মদপুর থানাধীন শঙ্কর এলাকায় ৯৭/১/এ নম্বর প্লটে আক্তারুজ্জামানের একটি চারতলা বাড়ি।
মৃত্যুর আগে আক্তারুজ্জামান তার স্ত্রী ফারহানা আক্তার নাসিমের নামে লিখে দিয়ে যান বাড়িটি। আক্তারুজ্জামান ও ফারহানা আক্তার নাসিম দম্পতির বড় ছেলে ফয়সাল জামান এআইইউবি থেকে ২০০৭ সালে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন। ফয়সাল জামানের সঙ্গে তার ক্লাসমেট সাদিয়া আকন্দের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
পরে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে তারা পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ফয়সাল জামান শিশুদের খেলনার ব্যবসা শুরু করেন। মিরপুরের পশ্চিম কাফরুলে ক্রিডেন্স ইন্টারন্যাশনাল নামে ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন তিনি।
ব্যবসায়িক পুঁজির প্রয়োজনে ফয়সাল জামান তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে আরব বাংলাদেশ ব্যাংক লি. দিলকুশা শাখা থেকে ২০১১ সালের ২৯ মে দুই কোটি নিরানব্বই লাখ টাকা ঋণ নেন। এ ঋণের বিপরীতে গ্যারান্টার হন তার মা ফারহানা আক্তার নাসিম।
ঋণের সিকিউরিটি হিসাবে শঙ্করের ৪ তলা বাড়িটি ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখেন তিনি। এজন্য ২০১১ সালের ৩০ জুন মোহাম্মদপুর সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে রেজিস্টার্ড দলিল (নং ৫১০০) করা হয়।
এদিকে এবি ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের কিস্তি এবং অন্য একটি ব্যাংক থেকে নেয়া ৪ লাখ টাকার ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করতে পারায় মা এবং ছোট ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয় ফয়সাল জামানের। এক পর্যায়ে ফয়সাল জামান নিজেদের বাড়ি ছেড়ে ২০৪/১, পশ্চিম কাফরুলের শ্বশুরবাড়িতে বসবাস শুরু করেন। শুধু তাই নয়, তার সঙ্গে মা-ভাইয়ের সব ধরনের যোগাযোগ তিনি বন্ধ করে দেন।
এরপর তিনি আলোচিত ঋণ জালিয়াতি ঘটনার জন্ম দেন। যা পরিবারের নজরে আসে ২০১৪ সালের ১৯ জুন। এদিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড ফারহানা আক্তার নাসিমের শঙ্করের বাড়িটি নিলামে বিক্রির জন্য সেখানে সাইনবোর্ড টানাতে যায়।
তখন ফারহানা আক্তার নাসিম ও তার ছোট ছেলে ফাইয়াজ জামান জানতে পারেন, আরিফুজ্জামান ও সাদিয়া জামান সনি নামে দু’ব্যক্তি ওই ৪ তলা বাড়িটি আইডিএলসি ফাইনান্স লি. দিলকুশা শাখায় বন্ধক রেখে ২০১৩ সালের ২৯ মে ৫০ লাখ টাকা লোন নিয়েছেন।
আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড দিলকুশা শাখার ম্যানেজার (ক্রেডিট এডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট অ্যান্ড কনজুমার ডিভিশন) হাসানুর রহমান ও কনজুমার ডিভিশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মোহাম্মদ শরীফুজ্জামান ঋণ অনুমোদন করেন।
ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ গ্রহীতা কাগজপত্রে নিজের নাম আরিফুজ্জামান, বাবার নাম মৃত আক্তারুজ্জামান, মায়ের নাম ফারহানা আক্তার নাসিম, সাং ৯৭/১/এ পশ্চিম ধানমণ্ডি চেয়ারম্যান গলি, থানা মোহাম্মদপুর উল্লেখ করেন।
তাছাড়া বলা হয়, তাকে (আরিফুজ্জামান) তার মা ফারহানা আক্তার নাসিম ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ মোহাম্মদপুর সাবরেজিস্ট্রার অফিসে হেবা দলিল নং ১৮৫৯ মূলে বাড়িটি লিখে দিয়েছেন। এ দলিলমূলে আরিফুজ্জামান ওই বাড়ির মালিক। সম্পত্তির মালিক হিসেবে আরিফুজ্জামান ৫০ লাখ টাকা ঋণের বিপরীতে ওই বাড়ির দলিল আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের কাছে বন্ধক রাখেন।
এমন খবর শোনার পর পরিবারটির ওপর বিনা মেঘে বজ পাত নেমে আসে। এরপর ফারহানা আক্তার নাসিম ও তার ছেলে ফাইয়াজ জামান উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন। আদালত আইডিএলসি ফাইন্যান্স লি.কে তাদের বাড়িটি নিলাম করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেন।
জানতে চাইলে ফারহানা আক্তার নাসিম যুগান্তরকে বলেন, ‘আরিফুজ্জামান নামে আমার কোনো ছেলে নেই। তাছাড়া ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ আমি কোনো দলিলও সম্পাদন করিনি।
তিনি বলেন, আমি প্রথমেই ধারণা করি, কোনো চক্র জাল দলিলের মাধ্যমে এ প্রতারণা করেছে। এরপর আমার ছোট ছেলে ফাইয়াজ জামান বাদী হয়ে আদালতে একটি মামলা করেন। মামলায় আরিফুজ্জামান, সাদিয়া জামান সনি, আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের ম্যানেজার হাসানুর রহমান, অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার মোহাম্মদ শরিফুজ্জামানকে আসামি করা হয়।
পুলিশ জানায়, এ মামলা দায়েরের পর আইডিএলসি ফাইন্যান্সের দুই কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা গেলেও আরিফুজ্জামান ও সাদিয়া জামান সনি নামে দু’জনকে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। আর এ কারণে ওই দলিলটিও জাল না আসল তা প্রমাণ কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় আদালত বিষয়টি তদন্ত করতে পিবিআইকে গত বছরের ৩ জুলাই তদন্তের নির্দেশনা দেন।
পিবিআই তদন্তে নেমে ৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করাসহ আইডিএলসি ফাইন্যান্স থেকে জমাকৃত দলিলটি জব্দ করে। মোহাম্মদপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে আরিফুজ্জামানের নামে লিখে দেয়া দলিলের ছায়াকপিও সংগ্রহ করা হয়।
এসব দলিলের টিপসহি সিআইডির আঙুলাঙ্ক বিশারদের কাছে পাঠানো হয়। ফারহানা আক্তার নাসিমের আঙুলের নমুনার চাপের সঙ্গে দলিলের আঙুলের চাপের মিল নেই মর্মে প্রতিবেদন দেয়া হয়। এভাবেই চাঞ্চল্যকর এমন জালিয়াতির ঘটনা বেরিয়ে আসে।
পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কতিপয় কর্মকর্তার সহযোগিতা নিয়ে ফয়সাল জামান তার এক বন্ধু এ আর সোহেলকে নিজের ছোট ভাই সাজান। ছোট ভাই ফাইয়াজ জামানের সঙ্গে নামের মিল রেখে তার নাম দেয়া হয় ফায়াজুজ্জামান। তাকে করা হয় ঋণের গ্যারান্টার। সোহেল বর্তমানে মালয়েশিয়ায় পলাতক। ঋণের সব কাগজপত্র সঠিক আছে মর্মে সার্টিফাই করেন আইডিএলসি-দিলকুশা শাখার তৎকালীন সেলস বিভাগের রিলেশনশিপ ম্যানেজার মো. মিনারুল ইসলাম।
পিবিআইর তদন্তে উল্লেখ করা হয়েছে, কর্তব্যে অবহেলা কিংবা ঋণ গ্রহীতার সঙ্গে যোগসাজশে অসত্য ও জাল কাগজপত্রকে সঠিক প্রত্যয়ন করেছেন মিনারুল ইসলাম। আর এ কারণেই ৫০ লাখ টাকা ঋণ পাওয়ার পথ সুগম হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন