নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের চার বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ ২৭ এপ্রিল। নিহত সাতজনের পরিবারের মধ্যে ৫টি পরিবার উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। রায় কার্যকরের অপেক্ষায় তীর্থের কাকের মতাে চেয়ে আছেন নিহতের পরিবারগুলো।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল অপহরণের সেই ঘটনা এখনও ভুলতে পারিনি শীতলক্ষ্যা তীরের মানুষ। ঘটনার পর র্যাবের তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার, প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনাসহ টান টান উত্তেজনায় পার হয়েছে ৪টি বছর। গত বছরের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের জজকোর্ট ও পরে হাইকোর্টেও রায় ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত ওই রায়ের পর এখন নিহতের স্বজনদের প্রত্যাশা দ্রুত সে রায় কার্যকর হোক। তাদের প্রত্যাশা আগামী সংসদ নির্বাচনের আগেই রায় কার্যকর করবে সরকার।
আলোচিত এ ঘটনায় যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান স্বপন, স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর, নজরুলের সহযোগী তাজুল ইসলাম, বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিমের পরিবার বর্তমানে অর্থকষ্টে জীবনযাপন করছেন। তারা উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাদের এখন একটাই দাবি, মামলার রায় দ্রুত কার্যকর করা।
নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, নুর হোসেন র্যাবের সহায়তায় সাতজনকে অপহরণ করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আমি চাই তাদের অন্যায়ের সাজা হোক। এ সাজা দেখে যেন মানুষ এ ধরনের অন্যায় করতে ভয় পায়। নিম্ন ও উচ্চ আদালতে যে রায় দিয়েছে এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। এ মামলার রায়টি এখন সুপ্রীমকোর্টে আছে। আমরা আশা করছি সুপ্রীমকোর্টও উচ্চ আদালতের রায় বহাল রাখবেন। আমরা এ রায়টি দ্রুত কার্যকরের দাবি জানাই।
তিনি আরও বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, সাত খুনের ঘটনায় সাতটি পরিবার তাদের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়েছে। সাতটি পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরাও আওয়ামী লীগের সন্তান। এ সাতটি পরিবারে যাদের চাকরির বয়স হয়েছে তাদের চাকরির সুযোগ করে দেয়ার আবেদন জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, এ রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে আতঙ্কের মধ্যেই থাকতে হচ্ছে। খুনিরা জেলে আছে কিন্তু তাদের সব কিছুই চলছে। এ বিচারের মাধ্যমে তাদের অপশক্তি ধ্বংস হয়ে যাক।
নিহত তাজুল ইসলামের বাবা আবুল খায়ের বলেন, আমরা তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে আছি কবে রায় কার্যকর হবে সেটা দেখতে। এ নির্মম নির্যাতনের বিচার এ দেশেই হবে? প্রধানমন্ত্রীর সেই মনমানসিকতা আছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছি। এ মামলায় যে কয়জন আসামি এখনও পলাতক রয়েছে তাদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনারও দাবি জানাই।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এই বৃদ্ধ বয়সে চাকরি করার কথা ছিল না। যদি আমার ছেলে তাজুল বেঁচে থাকত তাহলে কখনোই চাকরি করতে দিতো না। উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। যদি আমার আরেকটি ছেলেকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া হয় তাহলে কিছুটা হলেও পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারব।
এদিকে সাত খুনের চতুর্থ বার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার নিহতের পরিবারের সদস্যরা কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছেন। দ্রুত রায় কার্যকরের দাবিতে শুক্রবার বিকেল ৩টায় মৌচাক বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবে গণসংহতি আন্দোলন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা শাখা।
বিচারের আদ্যোপ্রান্ত
২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড ও বাকি ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করেন। পরে ওই বছরের ২২ আগস্ট আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের ওপর রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট বেঞ্চ। এতে সাত খুন মামলায় সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র্যাব-১১'র সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেনসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বাকি ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- প্রধান আসামি নূর হোসেন, র্যাবের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা (এমএম রানা), হাবিলদার এমদাদুল হক, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়্যব, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পুর্নেন্দ বালা, সৈনিক আবদুল আলীম, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী (পলাতক), সৈনিক আলামিন শরিফ (পলাতক) ও সৈনিক তাজুল ইসলাম (পলাতক)।
এছাড়া ১১ জনকে নারায়ণগঞ্জের নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ড দিলেও হাইকোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। তারা হলেন- র্যাবের সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, আবুল বাশার, নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল, নূর হোসেনের সহযোগী সেলিম, জামালউদ্দিন, এনামুল কবীর, সানাউল্লাহ সানা (পলাতক) ও শাহজাহান (পলাতক)।
নিম্ন আদালতে ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করা হয় যাদের রায় হাইকোর্ট বহাল রেখেছে তাদের মধ্যে করপোরাল রুহুল আমিনের ১০ বছর, এএসআই বজলুর রহমানের ৭ বছর, হাবিলদার নাসির উদ্দিনের ৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদের ১০ বছর, সৈনিক নুরুজ্জামানের ১০ বছর ও কনস্টেবল বাবুল হাসানের ১০ বছর। পলাতক আসামিদের মধ্যে হাবিবুর রহমানের ১৭ বছর, কামাল হোসেনের ১০ বছর ও মোখলেসুর রহমানের ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
কারাদণ্ড প্রাপ্তদের মধ্যে ৩ জন ও মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের মধ্যে ৯ জন পলাতক ছিলেন। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের মধ্যে সার্জেন্ট এনামুলক কবিরকে গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি মাগুরা থানা পুলিশ গ্রেফতার করে। এছাড়া গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি সৈনিক আবদুল আলীম ও গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ওয়াহিদুজ্জামান সেলিম আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ১৭ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কনস্টেবল হাবিবুর রহমান হাবিবকে গত বছরের ৩১ মার্চ বরিশাল পুলিশ গ্রেফতার করে। এছাড়া গত বছরের ১৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন নূর হোসেনের ঘনিষ্ট সহযোগী মত্যৃদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জামাল উদ্দিন।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। অপহরণের তিনদিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি মরদেহ। পরদিন মেলে আরেকটি মরদেহ।
নিহত অন্যরা হলেন- নজরুলের সহযোগী যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম।
ঘটনার একদিন পর কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন। এছাড়া আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পালও একই থানায় আরেকটি মামলা করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন