বাড়ির পাশের স্কুল মাঠে ক্রিকেট খেলার সময় বল ধরতে গিয়ে সহপাঠীর গায়ে ধাক্কা লেগে পড়ে যাওয়ায় সহপাঠীর বড় ভাইয়ের বর্বরোচিত নিষ্ঠুর নির্যাতনে একটি হাত হারাতে হলো রাজনের। ঢাকার কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে তার বাম হাতটি কেটে ফেলতে হয়েছে। ওই হাসপাতালের অষ্টমতলায় মহিলা ওয়ার্ডের ৯১২ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন রয়েছে শিশু রাজন।
তার অবস্থা এখনও শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে শিশু রাজন এখন পঙ্গুত্ববরণের অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছে। অপরদিকে প্রাণপ্রিয় শিশুসন্তানের চিকিৎসার অর্থের জোগান দিতে স্বজনরা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
নির্যাতনের শিকার শিশু রাজন কিশোরগঞ্জের সদর উপজেলার চৌদ্দশত ইউনিয়নের জালুয়াপাড়া গ্রামের দিনমজুর কাজল মিয়ার ছেলে ও জালুয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।
জানা গেছে, গত ১৫ এপ্রিল রোববার বিকালে নিজের স্কুল জালুয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে একই গ্রামের রায়হানের ছেলে রিয়ান ও অন্যান্য সহপাঠীদের নিয়ে রাজন ক্রিকেট খেলছিল। একপর্যায়ে ওপর দিয়ে আসা বল ধরতে গিয়ে রাজনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে ব্যথা পেয়ে কেঁদে ওঠে রিয়ান।
এ ঘটনা দেখে রিয়ানের বড় ভাই অষ্টম শ্রেণির ছাত্র রুমান ক্ষিপ্ত হয়ে দৌড়ে এসে রাজনকে ধরে মাথার ওপর তুলে পর পর তিনবার মাটিতে আছড়ে ফেলে। এতে বাম হাতের হাড় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে রাজন গুরুতর আহত হয়।
তাকে উদ্ধার করে প্রথমে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হলে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাৎক্ষণিক ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানেও জরুরি বিভাগ থেকে রাজনকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করে কর্তব্যরত চিকিৎসক। ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে নেয়ার পর সেখানেও রাজনের হাতের অবস্থা দেখে জরুরি বিভাগ থেকেই অন্যত্র নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দেয়া হলে সর্বশেষ রাজনকে ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে অর্থোপেডিক অধ্যাপক ডা. এ এস এম মনিরুল আলমের অধীনে ভর্তি করা হয়।
ডা. এএসএম মনিরুল আলম জানান,সেখানে গত ২৫ এপ্রিল অস্ত্রোপচার করে রাজনের বাম হাতটি কেটে ফেলা হয়। তার কিডনি আক্রান্ত হয়েছে, ফুলে শরীর ফুলে যাচ্ছে।
শুক্রবার বিকালে সরেজমিন পরিদর্শনকালে জালুয়াপাড়া গ্রামে রাজনদের বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের কান্নার মাতম শোনা যায়। শিশু রাজনের হাত কেটে ফেলার খবরে বাড়ির দুয়ারে বসে আহাজারি ও বুক ফাটা আর্তনাদ করে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন বাবা কাজল মিয়া, ফুফু ও দাদি। নিষ্ঠুর নির্যাতনে ছোট শিশুর একটি হাত ফেলে দেয়ার ঘটনায় পাড়া-প্রতিবেশীরাও ভিড় করে সমবেদনা জানাতে। শিশু রাজনের ওপর কিশোর রুমানের বর্বরোচিত নিষ্ঠুর নির্যাতনের আলোচনা এখন এলাকার লোকজনের মুখে মুখে।
এ সময় কথা হলে, বুক ও মাথায় হাত চাপড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে রাজনের বাবা বলছিলেন, ‘আমার শিশু পুতটা খুব বালা ছাত্র। সে কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করত না। রুমান আমার পুতটার বাম আতটা হারা জীবনের লাইগ্যা লইয়্যা গেছে। আমার পুতটার ভবিষ্যৎ অন্ধকার কইরা ফালছে। আমি ওই নরপিশাচ রুমানের ফাঁসি চাই।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একটি প্রভাবশালী মহল এ ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে রাজনদের পরিবারের ওপর নানাভাবে চাপ দিচ্ছে। তবে তার পরিবারের স্বজনরা জানান, সুদ-কর্জ করে টাকা সংগ্রহ করে রাজনের চিকিৎসার খরচ জোগানোর কাজে ব্যস্ত থাকায় এখন পর্যন্ত থানায় মামলা করা সম্ভব হয়নি। দু’একদিনের মধ্যেই এ ঘটনায় থানায় মামলা রুজু করা হবে।
এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি আবুশামা মো. ইকবাল হায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যুগান্তরকে জানান, এখন পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা নিয়ে কেউ মামলা করতে আসেননি। অভিযোগ নিয়ে কেউ আসলেই তাৎক্ষণিক যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন