ঢ্য ও উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সন্তানদের কয়েকজন এখন আফগানিস্তানের খোরাসানে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সিরিয়া ও সৌদি আরবে অবস্থানরত দুই বাংলাদেশি নিয়মিত তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট এই তৎপরতার খবর পেয়েছে বলে জানা গেছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, সিরিয়া ও ইরাকে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অবস্থা নাজুক হলেও আফগানিস্তানের খোরাসানে ইসলামিক স্টেট ইন খোরাসান প্রভিন্স (আইএসকেপি) শক্তিশালী অবস্থানে আছে। সে কারণে নব্য জেএমবির সদস্যদের এখন কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য খোরাসান।
২০১৫ সালে ইসলামিক স্টেট আফগানিস্তানের খোরাসানে আইএসকেপিকে তাদের অঙ্গসংগঠন বলে ঘোষণা দেয়। আফগানিস্তানে আইএসকেপি ও তালেবান জঙ্গিরা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। জঙ্গিবাদ নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের দাবি, সহিংসতার দিক থেকে তালেবানদের ছাড়িয়ে গেছে আইএসকেপি। তালেবান ছাড়াও শিয়া জনগোষ্ঠী ও বিদেশিদের ওপর ২০১৫ সাল থেকে ধারাবাহিক হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে তারা। এর মধ্যে এ বছরের শুরুতে সেভ দ্য চিলড্রেনের কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা করে তারা।
গত ২১ মার্চ বগুড়া থেকে গ্রেপ্তার নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা আকরাম হোসেন খান (নিলয়) এ ব্যাপারে তদন্ত কর্মকর্তাদের বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন। জানা গেছে, এই দলে সাত-আটজন নারী সদস্যও রয়েছেন। দলটির সঙ্গে সিরিয়া ও সৌদি আরবে অবস্থানরত আইএসপন্থী দুজন তরুণের ঘন ঘন যোগাযোগের তথ্যও রয়েছে। সিরিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশি এক তরুণের আইডি থেকে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের র্যালিতে হামলার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে, এমন প্রমাণও পুলিশের কাছে আছে।
সিরিয়া ও সৌদি আরবে যোগাযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, আকরাম হোসেন খান (নিলয়) সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। আকরাম দাবি করেছেন, তাঁর সঙ্গে হোলি আর্টিজানে হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরীর যোগাযোগ হয়েছিল।
কাউন্টার টেররিজমের উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বলেন, তামিম যাঁদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, আকরাম তাঁদের অন্যতম ছিলেন। নব্য জেএমবির সঙ্গে ধানমন্ডি ও গুলশানের তরুণদের সম্পৃক্ত করেন তামিম চৌধুরী।
জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে, স্কলাসটিকা স্কুল থেকে ও লেভেল এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে এ লেভেল শেষ করে মালয়েশিয়ার লিংকন ইনে পড়তে গিয়েছিলেন আকরাম। সেখানে গিয়ে তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। ২০০৪ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন ও গুলশানের একটি মসজিদে যাওয়া-আসা শুরু করেন। মসজিদে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় নাইজেরীয় নাগরিক আবদুল মাজেদ ওয়াহাবির। একই মসজিদে যাতায়াত ছিল গুলশান হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী নিবরাস ইসলাম, সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইমতিয়াজ এবং কল্যাণপুরে ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই পুলিশি অভিযানে নিহত শেহজাদ রউফ অর্ক ও আকিফুজ্জামানের। এই দলেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন ওয়াহাবি।
তবে আকরাম শুরু থেকে আইএসপন্থী নব্য জেএমবির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তিনি অন্য সবার মতো ‘হিজরত’ করেননি। তিনি গুলশানে নিজের বাসায় ছিলেন। হাজারীবাগে তামিম চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেছেন। বাড়িতে বাবা, মা ও বোনকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, শিক্ষিত তরুণদের কেউ কেউ এখনো ঘর ছাড়ছেন। চলতি মাসে ঢাকা, টঙ্গী ও চট্টগ্রাম থেকে তিন তরুণ নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এই তিন তরুণের একজন এমআইএসটি থেকে পাস করে লক্ষাধিক টাকার বেতনে চাকরি করতেন।
গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে অভিযান চালিয়ে জাতীয় শোক দিবসের র্যালিতে হামলার চেষ্টা তাঁরা ভেস্তে দিয়েছেন। তদন্তে জানা যায়, এই হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী আকরাম হোসেন খান (নিলয়) ময়মনসিংহের ভালুকায় বোমা বানানো, বোমা বহন করে ঢাকায় নিয়ে আসা, হামলাকারী নির্বাচনসহ সব কাজ চূড়ান্ত করেন। আকরাম এই কাজে যুক্ত করেছিলেন দারুস সালাম পাবলিকেশন্সের কর্ণধার তানভীর ইয়াসিন করিম ও তাঁর স্ত্রী হোমায়রা ওরফে নাবিলাকে। হোমায়রা ওরফে নাবিলা ও আকরামের বোন শুভর মাধ্যমে সংগঠনে যুক্ত সাত-আটজনকে নিয়ে খোরাসানে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
আকরাম হোসেন খান নব্য জেএমবির নারী সদস্য হোমায়রাকে খোরাসানে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। হোমায়রার সঙ্গে আকরামের পরিচয় শাম্মুর রাইয়ানের মাধ্যমে ২০১৫ সালে। ২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নাশকতা চেষ্টার অভিযোগে শাহবাগ থানায় নিবরাসসহ যে নয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তাঁদের একজন শাম্মুর। এই শাম্মুর হোমায়রার ছোট ভাইয়ের বন্ধু। ২০১৫ সালেই হোমায়রা দারুস সালাম পাবলিকেশন্সের কর্ণধার তানভীর ইয়াসিন করিমকে বিয়ে করেন।
আকরাম হোসেন খান নিলয়, তাঁর বাবা-মা ও বোন, হোমায়রা ও তাঁর স্বামী তানভীর ইয়াসিন করিম সবাই এখন কারাগারে। পুলিশের এসব বক্তব্য প্রসঙ্গে তাঁদের কোনো মতামত পাওয়া সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিরিয়া ও ইরাকে ঠিক কত যুবক আইএসের পক্ষে যুদ্ধ করছে, তা জানা যায়নি। আমার ধারণা, ২০০ থেকে ৩০০ জন হবে। কিন্তু শিক্ষিত উচ্চবিত্ত তরুণদের মধ্যে যারা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ, তাদের কোনো পরিসংখ্যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কাছে আছে বলে মনে হয় না।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন