সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপি নিন্দার ঝড় উঠেছে। সেই সাথে ছড়িয়েছে কিছু বিভ্রান্তিও। স্বভাবতই মানুষ এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্মদাতা ও নেপথ্যের দুষ্কৃতিকারীদের জানতে চায়। শাস্তি চায় এই অপকর্মের সাথে জড়িত সকলের। কিন্তু ঘটনাকে কেন্দ্র করে তথ্য উদঘাটনের বদলে যদি অসত্য সংবাদ কিংবা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়ে তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে নিরাপরাধ অনেকেরই। আমরা তাই জানার চেষ্টা করেছি সেদিন বাকেরগঞ্জে আসলে কী ঘটেছিল? উদঘাটন করার চেষ্টা করেছি নেপথ্যের অনেক তথ্য।
কী ঘটেছিল সেদিন: ১১ মে সকাল। ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার পর বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে বরিশালের বাকেরগঞ্জের কাঠালিয়া ইসলামিয়া দারুস সুন্নাত দাখিল মাদ্রাসা সুপার ও মসজিদের ইমাম মাওলানা আবু হানিফার মাথায় মল-মূত্র ঢেলে লাঞ্ছিত করে একদল দুষ্কৃতিকারী। শুধু লাঞ্ছিত করেই শেষ হয়নি, পুরো ঘটনা ভিডিও করে ছেড়ে দেয়া হয় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে। গত ১৩ মে ফেসবুকে ভাইরাল হলে নিন্দার ঝড় ওঠে অনলাইনে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানায় সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ। একজন আলেমকে এভাবে হয়রানি ও লাঞ্ছিত করার ঘটনায় নিন্দার ঝড় ওঠে সর্বমহলে।
জানা যায়, মাদরাসা পরিচালনা কমিটির নির্বাচনে হেরে মাদ্রাসা সুপারের মাথায় মল-মূত্র ঢেলে লাঞ্ছিত করেছে পরাজিত প্রার্থী ও তার লোকজন। সেই সঙ্গে মল-মূত্র ঢালার ওই ন্যাক্কারজনক দৃশ্যটি ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছেড়ে দেয় তারা। বরিশালে বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। লাঞ্ছিত আবু হানিফা (৫০) কাঁঠালিয়া ইসলামিয়া দারুস সুন্নাহ দাখিল মাদরাসার সুপার ও নেছারবাগ বায়তুল আমান জামে মসজিদের ইমাম।
যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে ভিডিও: প্রথমে মাদ্রাসা সুপার আবু হানিফাকে অপদস্থ করার ভিডিও ধারণ করে দুষ্কৃতিকারীরাই সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে। তবে কে বা কোন আইডি থেকে প্রথম পোস্ট করা হয় তা উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। এরপরই এই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুকের অনেক জনপ্রিয় পেজই ভিডিওটি শেয়ার করে এবং দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি করে শাস্তির দাবি করে। কিন্তু তখনও দুষ্কৃতিকারীদের সবার পরিচয় মেলেনি। তবে মাদরাসা পরিচালনা কমিটির নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী জাহাঙ্গীর খন্দকারের নাম আলোচনায় উঠে আসে তখনই।
হামলাকারীদের পরিচয়: আবু হানিফাকে প্রকাশ্যে হেনস্তাকারীদের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল শুরু থেকেই। সেই বিভ্রান্তিতে প্রণোদনা দেয় বেশ কয়েকটি ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়া। সঠিক তথ্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বরাবরের মতই প্রচার করা হয় হামলাকারীরা জামায়াত-শিবিরের লোক। কিন্তু আমরা চেষ্টা করেছি হামলাকারীদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে।
১.জাহাঙ্গীর খন্দকার: ন্যাক্কারজনক এই ঘটনার মূল অভিযূক্ত। মাদরাসা পরিচালনা কমিটির নির্বাচনে হেরে মাদ্রাসা সুপারের ক্ষোভ প্রকাশের এ ন্যাক্কারজনক পদ্ধতি প্রয়োগের মূল পরিকল্পনাকারী তিনি। ওই ভিডিওতে তার উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি দেখা যায়। কিন্তু কে এই জাহাঙ্গীর খন্দকার? অনুসন্ধানে উঠে এসেছে তার পরিচয়। উঠে এসেছে বিভিন্ন অপকর্মের খোঁজ।
জাহাঙ্গীর খন্দকার জাতীয় পার্টির একজন সক্রিয় নেতা। জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারের আত্মীয় ও ঘনিষ্টজন। তিনি ১২ নং রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য। শুধু তাই নয়, রুহুল আমীন হাওলাদারের সাথে সংশ্লিষ্টতার সুযোগে জাতীয় পার্টির বরিশাল জেলা সাংগঠনিক সম্পাদকও ছিলেন এই অভিযুক্ত জাহাঙ্গীর। বাকেরগঞ্জের ওই এলাকা পড়েছে বরিশাল-৬ আসনের মধ্যে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী রত্না আমিন হাওলাদার ২০১৪ সালে সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হন। সম্পর্কের দিক থেকেও জাহাঙ্গীর খন্দকার রুহুল আমিন হাওলাদারের খুব ঘনিষ্টজন হিসেবে এলাকায় পরিচিত। জাহাঙ্গীর খন্দকারের পুত্র হাসান খন্দকার বর্তমানে ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য।
জাহাঙ্গীর খন্দকার তার এলাকায় নারী ও মাদক ব্যবসায়ী হিসেবেও পরিচিত। তার বিরুদ্ধে একাধিক ব্যক্তির জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে হত্যার অভিযোগও। জমি দখল করতে গিয়ে জমির মালিক স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বী নাটু বাবুকে হত্যার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
২. সোহেল খন্দকার: সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওতে এক তরুণকে মাদ্রাসা সুপার আবু হানিফার হাত ধরে রাখতে দেখা যায়। লাল গেঞ্জি পরিহিত ওই তরুণ স্থানীয় এমদাদ খন্দকারের পুত্র সোহেল খন্দকার। সে মূল দুষ্কৃতিকারী জাহাঙ্গীর খন্দকারের ভাতিজা। পদ পদবী না থাকলেও সে স্থানীয় রঙ্গশ্রী ইউনিয়ন ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত।
৩. ইমন হাওলাদার: মাদ্রাসা সুপার আবু হানিফার মাথায় ও শরীরে মল ঢেলে লেপ্টে দেয়া যুবক ইমন হাওলাদার। স্থানীয় খলিল হাওলাদারের পুত্র তিনি। ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ইমন হাওলাদার জাহাঙ্গীর খন্দকারের প্রতিবেশী।
যেভাবে জড়ানো হলো জামায়াতকে: কোন ঘটনা ঘটলে স্বভাবতই পুলিশের যে ভূমিকা দেখা যায় এক্ষেত্রেও অনেকটা একই ভূমিকায় দেখা গেছে। ঘটনার ভিডিও থাকায় পুলিশ গতানুগতিকভাবে জামায়াত-শিবির জড়িয়ে বক্তব্য না দিলেও, গ্রেফতারের সময় একই ভূমিকা পালন করেছে। দারুস সুন্নাহ দাখিল মাদরাসার কাছাকাছি এলাকায় হেনস্তার শিকার আবু হানিফার ভাই জাকারিয়া হোসেন হামিদ ও জামায়াত সমর্থক স্থানীয় মিরাজ হোসেন ও মিনজুসহ বেশ কয়েকজন তরুণ একটি নূরাণী মাদ্রাসা চালু করেন। আবু হানিফা এতে ক্ষিপ্ত ছিলেন। তিনি এই নূরাণী মাদ্রাসার বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে মামলাও করেছেন। প্রতিহিংসা বশতঃ তিনি স্থানীয় প্রভাবশালী বেশ কিছু লোকের শরণাপন্নও হয়েছেন। দুই মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষের মধ্যে চাপা উত্তেজনাও ছিল। কিন্তু কেউ কখনই হাতাহাতি বা মারামারির পর্যায়ে যাননি।
উদ্দেশ্যমূলকভাবে জামায়াত-শিবির নিয়ে মিডিয়াকে অসত্য তথ্য দেন আবু হানিফা ও বশির উদ্দিন
আবু হানিফাকে হেনস্তা করার আগের রাত ৯ টার দিকে জাপা নেতা জাহাঙ্গীর খন্দকারের পুত্র হাসান খন্দকার ও তার দলীয় সন্ত্রাসীরা মিরাজ ও মিনজুকে চাঁদা দাবি করে তাদের বাড়িতে গিয়ে মারপিট করে। এবং অনেকটা বাধ্য করে দুই লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। জাহাঙ্গীর পুত্র হাসান খন্দকারের মারপিটে আহত হন মিরাজ ও মিনজু। রাতেই তারা বরিশাল শহরে চলে যান চিকিৎসার জন্য। পরের দিন সকালে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ইস্যুতে আবু হানিফাকে রাস্তায় ডেকে মাথায় ও শরীরে মল-মূত্র ঢেলে হেনস্তা করে জাহাঙ্গীর খন্দকারসহ তার অনুসারীরা। এই ঘটনার ভিডিও থাকলেও পুলিশ তাদের কাউকে গ্রেফতার না করে আগের দিন রাতে হাসান খন্দকারের হামলায় আহত জামায়াত সমর্থক মিরাজ ও মিনজুকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে গ্রেফতার করে। ন্যাক্কারজনক এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে পরের দিন বেশ কয়েকটি মিডিয়া বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কিন্তু তারাও আসল সত্যকে পাশ কাটিয়ে জামায়াতের কাজ বলে বরাবরের মতই প্রচার করে। মিডিয়ার প্রতিবেদনে রঙ্গশ্রী ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষমতাসীন দলের (ইউপি) চেয়ারম্যান বশির উদ্দিন এর একটি বক্তব্য প্রচার করা হয়। যেখানে সত্যকে আড়াল করে তিনি জামায়াত-শিবির সহ ঐ নূরাণী মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টদের দায়ী করে উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য দেন। অথচ ঐ নূরাণী মাদ্রাসা উদ্বোধনের সময় তিনি স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন এবং সহযোগিতা করেছেন।
আবু হানিফার বিভ্রান্তিকর তথ্য: এদিকে মাদ্রাসা সুপার ও ইমাম আবু হানিফা জাপা নেতা জাহাঙ্গীর ও তার বাহিনীর হামলার শিকার হলেও তিনি পূর্বশত্রুতাকে পুঁজি করে জামায়াতকে জড়িয়ে একাধিক মিডিয়ার সামনে বক্তব্য দিয়েছেন। মূলত জাপা নেতা ঐ মাদ্রাসার সভাপতি হতে চেয়েছিলেন এবং মাদ্রাসার কিছু জমি তার নিজের নামে লিখিয়ে নিতে না পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে তার সাথে এ বর্বর কান্ড ঘটান। কিন্তু আবু হানিফার একেক সময় একেক ধরণের বিভ্রান্তিকর তথ্যে সামাজিক মাধ্যমে জামায়াতকে ঘিরে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়। একজন আলেম ও শিক্ষক হিসেবে তিনি এই ঘটনার জন্য যে সহানুভূতি পেয়েছিলেন তাও প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে।
মোটকথা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের আওয়ামী লীগের এমপি লিটন জাতীয় পর্টির সাবেক এমপি আঃ কাদের খান কর্তৃক নিহত হওয়ার পর যেভাবে মিডিয়া জামায়াতে ইসলামীর ওপর দোষ চাপিয়েছিল, বাকেরগঞ্জের ঘটনায়ও অনেকটা তারই পুনরাবৃত্তি লক্ষ্য করা গেছে।
এদিকে বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের দারুস সুন্নাহ দাখিল মাদ্রাসার সুপার ও নেসারাবাদ বায়তুল আমান জামে মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা আবু হানিফাকে প্রকাশ্যে মাথায় মল ঢেলে দিয়ে লাঞ্ছিত করার ঘটনার সাথে জড়িত জাতীয় পার্টির নেতা জাহাঙ্গীর আলম খন্দকার ও তার সহযোগীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল ও সাবেক এমপি জনাব হামিদুর রহমান আযাদ। বিবৃতিতে তিনি বলেন- ‘একজন সম্মানিত আলেমের সাথে এ ধরনের কুরুচিপূর্ণ ও অসম্মানজনক আচরণের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।’
সংবাদ২৪৭
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন