সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল এলাকায় মহাসড়ক পরিদর্শন করতে গিয়ে ব্যাপক অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়। সড়ক ও জনপথ বিভাগের সচিব নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে পরিদর্শক দল এই অনিয়মের প্রমাণ পান। তাৎক্ষণিকভাবে সড়কে অনিয়ম ও নিম্নমানের কাজের বিষয়ে তদন্তে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন সচিব। কিন্তু পরে দেখা গেছে, ঠিকাদার সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলীদের মাধ্যমে সচিবকে ম্যানেজ করেন। ফলে সচিবের ইচ্ছায় ভিন্নভাবে পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি হয়। এতে অনিয়ম ও তদন্ত কমিটি গঠনের উল্লেখ করা হয়নি। এ নিয়ে সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কাজ শেষে বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাবে।’ তিনি মূলত দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ঠিকাদারকে রক্ষা করতেই তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয় এড়িয়ে গেছেন পরিদর্শন প্রতিবেদনে। প্রকারান্তরে এর মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি থেকে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবে সচিব নজরুল ইসলাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলীদের একের পর এক দুর্নীতির প্রশ্রয় দিয়ে আসছেন। একই অভিযোগ, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও। ২০১৭ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়ক পরিদর্শনে সিরাজগঞ্জে যান মন্ত্রী। সড়ক সংস্কারে গাফিলতির অভিযোগে স্থানীয় নির্বাহী প্রকৌশলীকে তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করেন। এ সময় ১০ দিনের মধ্যে সারা দেশের সব মহাসড়ক সংস্কার শেষ করার ঘোষণা দেন মন্ত্রী। কিন্তু পরে নির্বাহী প্রকৌশলীকেও পদায়ন করা হয় আর সড়কের সংস্কার আজ পর্যন্ত শেষ হয়নি। যার ফলে দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম বাড়ে সড়ক বিভাগে। আর অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবতে থাকে সওজ।
সূত্র বলছে, মন্ত্রণালয়ের এমন নমনীয় মনোভাব অর্থাৎ প্রশ্রয়ের কারণেই সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা এখন অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। এদিকে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলীদের নিয়ন্ত্রণের যা কিছু ক্ষমতা ছিল মন্ত্রণালয়ের হাতে সবই সম্প্রতি ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর এ কারণে সড়ক বিভাগের প্রকৌশলীরা দুর্নীতিতে এখন আরও বেপরোয়া ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছেন। এতে সড়ক বিভাগের ওপর মন্ত্রণালয় যে মনিটরিং ব্যবস্থা ছিল সেটিও অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
প্রকৌশলীরা নিয়ন্ত্রণহীন, মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং অকার্যকর
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ তথা সওজ গেজেটেড সংস্থাপন শাখা থেকে ১ এপ্রিল, ২০১৮ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। যার স্বারক নং ৩৫.০০.০০০০.০২২.১২.০০৪.১৫-২৪৮/১(২৫)। এই অফিস আদেশে পদায়নসহ ৫ম গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়নের ক্ষমতা সওজ’র প্রধান প্রকৌশলীকে দেওয়া হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলামের নির্দেশে জারি করা এই প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন উপসচিব মোছাম্মাৎ ফারহানা রহমান।
আদেশে বলা হয়, ‘পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন প্রকল্পে ও সংস্থায় প্রেষণজনিত নিয়োগ/বদলি ব্যতীত এবং পদোন্নতি/বদলি দায়িত্ব প্রদানের আদেশ জারির পর প্রথম পদায়নসহ ৫ম গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তাদের অন্যান্য বদলি/পদায়ন প্রধান প্রকৌশলী কর্তৃক সম্পাদিত হবে।’ এতে আরও বলা হয়, ‘এ বিভাগের গত ২৪/৬/২০১৪ তারিখের ৩৫.০২২.০০৫.০০.০০.০০৯.২০১২.-৪৯২ সংখ্যক অফিস আদেশের ক্রম-২ এর অংশটুকু এতদ্বারা বাতিল করা হলো।’ এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে আদেশে উল্লেখ রয়েছে। এর আগে একই বিভাগ থেকে ৩১ জানুয়ারি, ২০১৮ আরেক অফিস আদেশেও একই ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ‘পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের পদায়ন/বদলি এবং চলতি দায়িত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে নি¤œরূপ নির্দেশনা অনুসৃত হবে। ১. ৫ম গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তাদের দীর্ঘমেয়াদী বিদেশ প্রশিক্ষণ ও উচ্চ শিক্ষা শেষে এ বিভাগে যোগদান করতে হবে। যোগদানপত্র এ বিভাগ হতে পৃষ্ঠাংকনের পর প্রধান প্রকৌশলী তাদের পদায়ন করবেন। এছাড়া, প্রেষণ ব্যতীত ৫ম গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তাদের উন্নয়ন প্রকল্পে পদায়ন প্রধান প্রকৌশলীর মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। ২. জোনের অভ্যন্তরে উপসহকারী প্রকৌশলীদের বদলি/পদায়ন জোন প্রধান হিসেবে সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী করবেন। ৩. চলতি দায়িত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দায়িত্ব সংক্রান্ত এ বিভাগের গত ২২/১১/২০১৫ তারিখের ৩৫.০২২.০০৫.০০.০০.০০৯.২০১২-৮৮৮ সংখ্যক অফিস আদেশ এতদ্বারা বাতিল করা হল।’ এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করা হবে বলেও আদেশে উল্লেখ করা হয়। যার স্বারক নং ৩৫.০০.০০০০.০২২.১৬.০০১.১৮.-১০৫/১(৫০)। এতেও স্বাক্ষর করেন সিনিয়র সহকারী সচিব মোছাম্মৎ ফারহানা রহমান।
এই সুযোগ পাওয়ায় সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। প্রধান প্রকৌশলীকে ম্যানেজ করে সড়কের ঘুষ এখন ওপেন সিক্রেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৌশলীদের বদলী-পদায়নের ক্ষমতা মন্ত্রণালয় থেকে চলে যাওয়ায় মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং ব্যববস্থা অত্যন্ত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। প্রকৌশলীরা এখন মন্ত্রণালয়কে মানতে চাইছেন না। ফলে রাস্তায় দেশবাসীর ভোগান্তির সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশা
দেশের সড়ক ও মহাসড়কের দৈন্যদশা- এটা এখন আর ঘটা করে বলার দরকার নেই। সড়ক সম্প্রসারণ ও সংস্কার খাতে দফায় দফায় বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে। কিন্তু লুটপাট প্রবণতার কারণে সেইসব অর্থ যথাযথ খাতে ব্যয় হচ্ছে না। এতে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। বছর জুড়েই সড়কের এই বেহাল দশা। কেবল ঈদ এলেই দুরবস্থার চিত্রটি সংবাদ মাধ্যমে জোরোসোরে উঠে আসে। তখন মেরামতের তোড়জোড় শুরু হয়। মন্ত্রী সংশ্লিষ্ট দফতরের প্রকৌশলীদের বহর নিয়ে বিভিন্ন সংস্কার কাজ পরিদর্শনে ব্যস্ত হয়ে উঠেন। কিন্তু ঈদ চলে গেলে সড়কগুলোর আর কোনো খবর রাখে না কেউ। এ নিয়ে মাথাব্যথা থাকে না কারো। এমন অভিযোগ দেশবাসীর। ভুক্তভোগী অনেকেই বলেছেন, বিষয়টি এমন, সারা বছর সড়কের অবস্থা যেমনই থাকুক, ঈদে কোনোরকমে মানুষকে ঘরে পৌঁছে দিতে পারলেই বিরাট দায়িত্ব পালন হয়ে গেল সড়ক মন্ত্রী ও বিভাগের। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সড়কের ভাঙাচোরা জায়গাগুলোতে ইট-বালু ফেলে এক ধরনের অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়। সেই ফাঁকে লুটপাট হয় সরকারের শ’ শ’ কোটি কোটি টাকা। তারপর এগুলো ভেঙে গেল, না খানাখন্দে মরণ ফাঁদ হলো, তাতে কিছু যায় আসে না কারো। তারা এও বলছেন, সংস্কার কাজে অর্থ বরাদ্দ যে থেমে থাকে তাও নয়, সারা বছরই এ খাতে অর্থ ব্যয় হয়, টেন্ডার হয়, কার্যাদেশ হয়। গত ৯ বছরে সড়ক ও সেতুতে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। অথচ সড়ক মেরামত আর হয়ে উঠে না। দেশবাসীর ভোগান্তিও দূর হয় না। টাকা সড়কের গর্তেই পড়ে থাকে।
সূত্র বলছে, সড়ক-মহাসড়ক সম্প্রসারণ ও সংস্কারের নামে সারা বছরই এক ধরনের আর্থিক লুটপাট চলে সওজ বিভাগে। সড়ক ও মহাসড়কের দুর্দশা, রাজধানী থেকে দেশের যে প্রান্তেই যাওয়া হোক না কেন, তার করুণচিত্র দেখা যায়। পরিবহন ব্যবসায়ীদের মতে, দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে দ্রুতই তা ভেঙে যায়, মেরামত করতে হয়। কারণ মেরামত মানেই নতুন বরাদ্দ। এতে লুটপাটের সুযোগ বাড়ে। কিন্তু টেঁকসইভাবে কখনোই সড়ক নির্মাণ বা সংস্কার করা হয় না। সড়ক পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়কে দুর্ঘটনার জন্য খানাখন্দ একটি অন্যতম কারণ। তা জানার পরও মন্ত্রণালয় কখনোই এ নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। বরং প্রকৌশলীদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাত থেকে ছেড়ে দেওয়ার পর এখন সারা দেশের সড়ক মহাসড়কের চিত্র অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। অনেক সড়কের অবস্থা এমনই যে ব্যবহারের অনুপোযোগী।
মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা বিভাগ (এইচডিএম)-এর জরিপ মতে, জাতীয় সড়কের শতকরা ২০ ভাগ, আঞ্চলিক সড়কের ৩১ ভাগ এবং জেলা শহরের ৪৭ ভাগ সড়কই প্রায় সারা বছর ভাঙাচোরা থাকে। এছাড়া সড়কের ব্রিজ, কালভার্ডগুলোর বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ। যদি সড়ক-মহাসড়কগুলো মসৃণ ও নির্বিঘœ হতো, সড়কে দুর্ঘটনা ও যানজটের পরিমাণও কমে আসতো। কিন্তু মেরামত বা সংস্কারে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও সড়ক-মহাসড়কের কোনো উন্নতি নেই। ফলে প্রতিদিনই যানজট লেগে থাকছে দেশের প্রধান সড়কগুলোতে। মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। বাড়ছে দুর্ঘটনাও। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মহাসড়কে আটকা পড়ে শ্রম, অর্থ ও জ্বালানির ক্ষতি হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছার বিষয়টি স্বপ্নের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
মহাসড়ক ব্যবস্থাপনার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা সড়ক-মহাসড়ক খাতে বরাদ্দ করা হয়। সড়ক পরিবহন, মহাসড়ক, সওজ মিলে গত অর্থ বছরে এর মধ্য থেকে ব্যয় করে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এত অর্থ ব্যয় করেও মসৃণ হয়নি সড়ক। যা প্রমাণ করে, সংস্কার কাজে গাফিলতি, দুর্নীতি ও অনিয়ম ব্যাপক হারে হয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, দেশের জনগণের দুর্ভাগ্য, সংস্কারের নামে তাদের টাকা নিয়ে একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ তা লুটেপুটে খাচ্ছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করছে। দেশের অর্থের অপচয় হচ্ছে। আর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে জনসাধারণকে। এ ক্ষেত্রে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং সড়ক বিভাগ যথেষ্ট দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্রমতে, উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার সড়কে প্রায় দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় হয়। এর পেছনে যে দুর্নীতি ও অনিয়ম মূল নিয়ামক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থের অপচয় ও লুটপাটের ক্ষেত্রে সড়ক বিভাগই সেরা বলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীর সব দেশে সাধারণত সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে এর উপকরণের টেকসইয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করতে রোদ, বৃষ্টি ও বন্যার বিষয়টি মাথায় রেখে উপকরণের মান নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মান নিয়ন্ত্রণের কোনো বালাই নেই।
মহাসড়ক মানেই মহাদুর্ভোগ
রাস্তার পিচ উঠে গেছে আগেই। আবার আসছে ঝড়, বৃষ্টি। বৃষ্টির পানিতে দিনে দিনে বাড়ছে গর্ত। গর্তে জমে থাকা কাদা-পানি গাড়ি চলাচলের সময় ছিটে ফুটপাথের মানুষের পোশাক নোংরা করে যায়। হেলে দুলে ধীর গতিতে চলে পরিবহন। গর্তের কাদা-পানি শুকিয়ে গেলে যানবাহন চলাচলে ধুলায় ঢেকে যায় সড়কের চারদিক। অথচ সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) অধীন দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-সেতু মেরামত ও নির্মাণে গত আট বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরসহ এ ব্যয়ের পরিমাণ ৫৫ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে। তারপরও সড়কের রূপ বদলায়নি। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মহাসড়কের স্থানে স্থানে খানাখন্দ, সড়কপথে যাতায়াত কঠিন হয়ে পড়েছে। জেলা ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। জোড়াতালির মেরামত, পরক্ষণেই গর্ত-এই চক্রেই চলছে।
এশিয়ায় দ্বিতীয় নিকৃষ্ট সড়ক বাংলাদেশে
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ও সওজ সূত্র বলছে, দেশে সড়ক উন্নয়নে ৩১ হাজার কোটি টাকা ও রক্ষণাবেক্ষণে ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে ৮ বছরে। কিন্তু ১,০৬০ কিমি চার মহাসড়কের অর্ধেকই বেহাল। এ জন্য দায়ী করা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঠিকাদার নিয়োগ, নিম্নমানের কাজ, অতিরিক্ত মালবাহী যান ও দুর্বল পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে।
এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকা থেকে সিলেট, রংপুর, খুলনা ও বরিশালে যাওয়ার দেশের চারটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক রয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত দূরত্ব ১ হাজার ৬০ কিলোমিটার। তথ্য বলছে, এই চার মহাসড়কের ৩৫০ কিলোমিটারই দুর্ভোগ সঙ্গী করে চলতে হয়। এর মধ্যে প্রায় ৬৭ কিলোমিটার খুবই বেহাল, যানবাহন চলছে খুব কষ্ট করে। বাকিটিতে আছে ভাঙাচোরা-খানাখন্দ। এমনকি ঢাকা-চট্টগ্রাম পথের দূরত্ব ২৪২ কিলোমিটার এবং গত বছর চার লেনে উন্নীত করার পরও এক বছরের মাথায় সড়কটিতে এরই মধ্যে খানা-খন্দের সৃষ্টি হয়েছে। তবে মেঘনা-গোমতী সেতুতে অব্যবস্থাপনার কারণে যানজট নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল বাদ দিলে দেশের প্রায় সব জেলার বাসিন্দাদেরই এই পাঁচ মহাসড়কের পুরোটা অথবা আংশিক ব্যবহার করে চলতে হয়।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা প্রতিবেদন ২০১৭ অনুযায়ী, এশিয়ার মধ্যে অন্যতম নিকৃষ্ট সড়কের দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। কেবল নেপাল বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ। আর সওজের হাইওয়ে ডিজাইন ম্যানুয়াল (এইচডিএম) বিভাগের ২০১৬ সালের আগস্টের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের ৩৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক খারাপ। ৩৯ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক ভালো। আর সাড়ে ২৩ শতাংশ চলনসই। এরপর তারা গত নভেম্বর থেকে নতুন করে জরিপ শুরু করেছে। এর প্রাথমিক ফল অনুযায়ী, সড়ক-মহাসড়কের অর্ধেকই খারাপের পর্যায়ে চলে গেছে। এর মধ্যে খুলনা অঞ্চলের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের সড়কের অবস্থাও খারাপ। অথচ প্রতিবছরই সড়কে বাজেট বরাদ্দ বেড়েই চলছে। তাহলে বাজেটের অর্থ কোথায় যায়-এমন প্রশ্ন তুলেছেন ভুক্তভোগিরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সওজের অধীনে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এগুলো জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক-এই তিন ভাগে ভাগ করা আছে। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক ৩ হাজার ৮১৩ কিলোমিটার। এর বাইরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) অধীন সড়ক আছে ৩ লাখ কিলোমিটারের বেশি। যার সবই গ্রামীণ সড়ক। বাংলাদেশে মানুষ মূলত মোট যাতায়াতের ৮৮ শতাংশই করে সড়কপথে। বাকিটা রেল, নৌ ও আকাশপথে হয়ে থাকে।
সড়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, রাজস্ব খাতের বেশির ভাগ অর্থই ব্যয় হয় যথাযথ দরপত্র ছাড়া, রাজনৈতিক ঠিকাদারদের পেছনে। আর উন্নয়ন প্রকল্পেও নয়ছয়ের কারণে যথাযথ ও সময়মতো কাজ হয় না। অব্যবস্থাপনা তো আছেই। সব মিলিয়ে নতুন কিছু সড়ক-সেতুসহ উন্নয়নমূলক কাজ হলেও এর জন্য মানুষকে চরম মূল্য দিতে হয়। সড়কের দুরবস্থার বিষয়ে সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) বলেছেন ‘ভারী বর্ষা ও বন্যার কারণে এবার সড়ক কিছুটা খারাপ। মেরামতের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে, কাজও চলছে। মে মাসের মধ্যে সব সড়ক ঠিক হয়ে যাবে।’
গুরুত্বপূর্ণ চার মহাসড়কে সীমাহীন ভোগান্তি
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিম্নমানের কাজের কারণে সড়কে দ্রুতই খানাখন্দ দেখা দেয়। সেই সাথে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকা- ও অব্যবস্থাপনা-এই তিন কারণে দেশের চারটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে মানুষের যাত্রা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক: ঢাকা থেকে রংপুর পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ৩০৭ কিলোমিটার। যমুনা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে রংপুরের দিকে যাত্রা করলে ২১৫ কিলোমিটার পথই অত্যন্ত দুর্ভোগের যাত্রা। প্রায় তিন বছর ধরে গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। এ সময় পুরোনো সড়কটি এই ভাঙে, এই মেরামত-এভাবে চলছে। এখনো চার লেনের কাজ সম্পন্ন হয়নি। ফলে ধুলার ওড়াউড়ি তো আছেই। সেতুগুলোর সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। তাই যানজট নিত্যদিনের। এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড় পর্যন্ত ৩০-৩৫ কিলোমিটার সড়ক মোটামুটি ভালো। কিন্তু সিরাজগঞ্জের নলকা থেকে চান্দাইকোনা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ। হাটিকুমরুল মোড় এলাকার মহাসড়ক অত্যন্ত জীর্ণদশায়। ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের বগুড়া ও গাইবান্ধা জেলায় পড়েছে ৯৭ কিলোমিটার। এর পুরোটাই খানাখন্দে ভরা। বিশেষ করে গাইবান্ধা অংশের অবস্থা খুবই খারাপ। মাঝেমধ্যে চলে জোড়াতালির মেরামত। একই অবস্থা মহাসড়কের রংপুর অংশের ২৩ কিলোমিটারের।
ঢাকা-সিলেট: ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব ২৪৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ৯০ কিলোমিটার অংশই ভাঙাচোরা। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলার অংশে বেশি দুরবস্থা। এই সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার লক্ষ্যে চায়না কোম্পানির সঙ্গে প্রাথমিক চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবকে ঘুষ সাধেন বলে অভিযোগ তুলেন সচিব নজরুল ইসলাম। যে কারণে চূড়ান্ত চুক্তি হয়নি। প্রকল্পের অধীনে চলে যাবে বলে কোনো রকমে জোড়াতালির মেরামত দিয়ে চালানো হচ্ছে। তবে একটি সূত্র বলছে, সচিবকে ঘুষ সাধা নয়, অন্য একটি প্রতিষ্ঠান সচিবকে ম্যানেজ করেছে। তাদেরকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য চায়নার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতেই ৫০ লাখ টাকা ঘুষ সাধার নাটক সাজিয়ে ছিলেন সচিব নজরুল ইসলাম। উল্লেখ্য, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির ৫০ লাখ টাকা ঘুষ ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে দাবি করেন। যা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়। ঘুষ প্রদানের দায়ে চায়না হারবারকে কালো তালিকাভুক্ত করার ঘোষণাও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
ঢাকা-খুলনা: এদিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দূরত্ব ২৭১ কিলোমিটার। মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া পর্যন্ত মোটামুটি যান চলাচলের যোগ্য। কিন্তু দৌলতদিয়া থেকে খুলনা পর্যন্ত মহাসড়কের অবস্থা করুণ। এর মধ্যে যশোর-খুলনা অংশের ৩৩ কিলোমিটার খানাখন্দে ভরা। রাজবাড়ী ও মাগুরা অংশে মেরামতের পরই আস্তরণ উঠে গেছে। এই মহাসড়কের আরেকটি অংশ টঙ্গী থেকে নরসিংদীর পাঁচদোনা পর্যন্ত। প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথে গর্ত এতই বড় যে কয়েকটি কোম্পানি তাদের বিলাসবহুল বাসের চলাচলের পথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে।
সূত্র বলছে, অর্থনীতির অন্যতম লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। এই মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ শেষ হয়েছে গত বছর। অথচ ২৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করার বছর পার হতে না হতেই এরই মধ্যে খানাখন্দ দেখা দিয়েছে। নিম্নমানের কাজের কারণে এমনটি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। এছাড়া মেঘনা ও গোমতী সেতু দুটি দুই লেনের এবং দুই পাশের সড়ক চার লেনের বলে যানজট সেখানে নিত্যদিনের। এর মধ্যে অতিরিক্ত মালবাহী যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপনের পর জট আরও বেড়েছে।
ঢাকা-বরিশাল: সড়কপথে ঢাকা-বরিশালের দূরত্ব ২৩৮ কিলোমিটার। এই সড়কে আসল দুর্ভোগ পদ্মার ওপারে। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে মাদারীপুরের কালকিনি পর্যন্ত ৪৭ কিলোমিটার সড়কের বেশির ভাগই খানাখন্দে ভরা। ইট-খোয়া দিয়ে কোনো রকমে মেরামত করার পরও তা টিকছে না। এরপর বরিশালের গৌরনদী থেকে উজিরপুর পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার সড়ক দীর্ঘদিন ধরেই বেহাল দশা। একই মহাসড়কের বরিশাল থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার অংশের বেশিরভাগই যান চলাচলের অনুপোযোগি। এর মধ্যে পায়রা নদীর ওপর লেবুখালী ব্রিজের কাজ ২০১৩ সালে ভিত্তি স্থাপন হলেও গত পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। এতে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমেছে।
মেরামতে গলদ, দ্রুত ভাঙছে সড়ক
উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে নির্মাণ ও সম্প্রসারণকাজ চলার সময় বিদ্যমান সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ হয় না বললেই চলে। এদিকে উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হওয়ারপর কিছু দিনের মাথায় দেখা যায়, দ্রুতই ভাঙাচোরা হয়ে যাচ্ছে। নিম্নমানের কাজের কারণেই এমনটি হচ্ছে। সওজের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা হয় তিনভাবে। এগুলো হচ্ছে দরপত্রবিহীন, সীমিত ঠিকাদারের মধ্যে দরপত্র ও উন্মুক্ত দরপত্র। দরপত্রবিহীন কাজ অনেক সময়ই সওজ নিজে মালামাল কিনে ঠিকাদারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে। অবৈধ লেনদেন ও রাজনৈতিক বিবেচনায় ঠিকাদারদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। লাখ লাখ টাকার কাজ এভাবে করা হয়। সীমিত দরপত্র হয় সাধারণত জরুরি প্রয়োজনে। তা সাধারণত কোটি টাকার ওপরে। এই দুই প্রক্রিয়ায় যে মেরামত হয়, এর বেশির ভাগই অপচয়। ভারী মেরামতের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। এই তিন ধরনের দরপত্রেই রাজনৈতিক ঠিকাদারদের দৌরাত্ম্য বেশি। অরাজনৈতিক ঠিকাদার কাজ পেলেও রাজনৈতিক ঠিকাদারকে কমিশন দিতে হয়।
সওজের মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা ও ঠিকাদার বলেছেন, ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়হীন কিংবা রাজনৈতিক ঠিকাদারের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া অন্য ঠিকাদারেরা সওজের কার্যালয়ে যেতেই পারেন না। এটা শুধু সওজ নয়, এলজিইডি, গণপূর্ত, গণস্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রকৌশল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ওয়াসাসহ সরকারে সব দফতরগুলোতে একই অবস্থা। আবার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রায়ই পরিদর্শনের নামে বিভিন্ন জেলায় যান। তখন সড়ক মেরামতের টাকা থেকে তাদের আপ্যায়নসহ সব খরচ বহন করা হয়। এছাড়া স্থানীয় প্রকৌশলী ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের জন্য নির্ধারিত পার্সেন্টেজ দিতে হয়। নয়তো বিল পাস হয় না। ফলে কোনো কাজেই সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও বুয়েটের পুর কৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, সড়ক নির্মাণে নিয়োজিত ঠিকাদার, উপকরণ ও নজরদারি-তিনটিতেই ঘাটতি আছে। এ জন্যই দ্রুত সড়ক ভেঙে যাচ্ছে। যথাযথ যন্ত্রপাতি ও দক্ষতা নেই-এমন অপেশাদার ঠিকাদারেরা গুরুত্বপূর্ণ সড়ক নির্মাণ বা মেরামতের কাজ পেয়ে যাচ্ছেন। আর তারা সরকার দলীয় প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের ওপর নজরদারিও কম। মোয়াজ্জেম হোসেন মনে করেন, ‘বর্তমানে সড়কে ৩০ বছরের পুরোনো উপকরণ-প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। যা ভারী যানবাহনের চাপ নিতে পারছে না। তাই বিটুমিনের সঙ্গে আধুনিক কিছু উপকরণ ব্যবহার করা গেলে পানি এবং ভারী যানের ক্ষতি থেকে কিছুটা রক্ষা করা যাবে। তবে সবকিছুর আগে নজরদারি জরুরি।’
মহাসড়ক সংস্কারে স্থায়ী সমাধান নেই কেন?
দেশে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দেশের সব মহাসড়ক ১০ দিনের মধ্যে সংস্কার করে সচল করার নির্দেশ দিয়েছেন গত বছরের আগস্টে। এর পর ১০ দিন নয়, গত ১০ মাসেও বাস্তবে সড়কের রূপ বদলায়নি। অথচ কোনো দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলীকে চাকরি হারাতে বা বড় ধরনের শাস্তিও পেতে হয়নি। যদিও সরকারি বরাদ্দের ঘাটতি ছিলো না। এতে দুর্নীতিবাজরা এখন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তবে সড়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহাসড়কগুলোর টেকসই সমাধানের উদ্যোগ না নেওয়ায় অনেক মহাসড়কের বেহাল দশা থেকেই যাচ্ছে। গত বছরের আগস্টে মন্ত্রী ঢাকা-বগুড়া মহাসড়ক পরিদর্শনে গিয়ে সিরাজগঞ্জ এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সংস্কার না করায় সেখানকার নির্বাহী প্রকৌশলীকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। তখন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘অতি বর্ষণে মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বগুড়া থেকে ঢাকায় আসতে চার বা সাড়ে চার ঘণ্টার জায়গায় এখন দ্বিগুণ সময় লাগছে।’ তিনি তাই দেশের সব মহাসড়ক ১০ দিনের মধ্যে সংস্কার করে সচল করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে তখন জানান। এর প্রেক্ষিতে ওই সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ‘সপ্তাহ দুয়েক পরই ঈদ উল আযহা সামনে রেখে মহাসড়কে চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। এ ধরনের কোনো উৎসব এলেই হুড়োহুড়ি করে অ্যাডহক ভিত্তিতে কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়। সেটা টেঁকসই বা স্থায়ী সমাধান হয় না।’ এই বিশেষজ্ঞের মতে, ‘মহাসড়কে যে জায়গাগুলোতে সংস্কার দরকার, সেগুলোতে যানবাহনের অত্যাধিক চাপ রয়েছে। এর সাথে বর্ষা মৌসুম। এই অবস্থায় অত্যন্ত অস্থায়ী ভিত্তিতে খোয়া দিয়ে কিছু একটা হয়তো করার চেষ্টা হবে। জরুরি ভিত্তিতে কোনভাবে ঠেকা দিয়ে যেন ইভেন্টটাকে পার করা যায়। কিন্তু টেকসই সমাধান যে করা যায়, সেদিকে আমরা যাচ্ছি না।’ রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তা তাৎক্ষণিকভাবে সংস্কারের ব্যবস্থা সরকারের থাকে বলে বলা হয়। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মহাসড়কে ব্যাপক ক্ষতির পরও সংস্কার করা হয়নি- এমন অভিযোগ উঠেছে।
সড়কের জন্য কাদেরকে দুষলেন মুহিত
এদিকে বেহাল সড়ক নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছেন, ‘দেশের রাস্তাগুলো ধ্বংস হওয়ায় মানুষের কষ্ট, এটা সবচেয়ে প্রকট। সারা দেশে রাস্তার অবস্থাই খারাপ। দেশের বদনামও এ জন্যই।’ এজন্য তিনি মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে দুষলেন। গত ১২ এপ্রিল, সোনারগাঁও হোটেলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরামর্শক কমিটির সভায় বক্তব্যে সড়কের অবস্থা নিয়ে এ মন্তব্য করেন মুহিত। অর্থমন্ত্রী সড়ক উন্নত করতে উদ্যোগ নেওয়ার প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা এ থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছি। এ জন্য রাস্তার গ্রেডিং আন্তর্জাতিক মানের করা হচ্ছে। গাড়ি চলাচলে যাতে দেশে একটি সিস্টেম প্রবর্তিত হয়, সেজন্য রাস্তায় বড় গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনারও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। রাস্তা যারা তৈরি করবে, তাদের তিন বছর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়ার একটা পরিকল্পনাও আছে।’
তবে সড়ক-মহাসড়কের সত্যিকারের উন্নয়ন ও টেকসই করতে দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই সাথে তারা এও বলছেন যে, সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের গ্যারান্টি থাকতে হবে। অন্যথায় সড়কে টাকা খরচই শুধু হবে কিন্তু জনদুর্ভোগ শেষ হবে না।
(সাপ্তাহকি শীর্ষকাগজে ৭ মে ২০১৮ প্রকাশতি)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন