‘কোন কোটাই থাকবে না।’ মহান জাতীয় সংসদে এভাবেই চাকরির বাজারে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতির বিলোপ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর আগে কোটা ব্যবস্থাকে নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা উল্লেখ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেছিলেন, ‘কোটা ব্যবস্থা তুলে দেওয়া উচিত। কোনো দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কোটা ব্যবস্থা চলতে পারে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘কোটা নিয়ে আমার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত এবং পরিষ্কার। আমার মনে হয় না বর্তমানে ১০ শতাংশের বেশি কোটা থাকা উচিত। আর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের নামে যে কোটা আছে, সেটা এখন আর থাকা উচিত নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের সন্তানরাও এখন বড় হয়ে গেছে। তাই এটা এখন কোনভাবেই চলা উচিত নয়। এটা মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা।’
যারা চাকরির বাজারে হন্যে হয়ে ঘুরে ফিরেন তারাই শুধুমাত্র বুঝতে পারেন এই কোটার বিরম্বনা। চাকরিতে যোগ্যতার মানদণ্ডে উপরের সারিতে থেকেও কোটার মারপ্যাঁচে ছিটকে পড়ছেন অনেক মেধাবী তরুণ-তরুণী। সেখানে স্থান করে নিচ্ছেন অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা। সরকারি চাকরির ১০০টি পদের ৫৫টি বিভিন্ন কোটায় সংরক্ষিত। এর মধ্যে ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ ভাগ জেলা, ১০ ভাগ নারী এবং ৫ ভাগ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত। মেধাভিত্তিক নিয়োগের সুযোগ মাত্র পাচ্ছে ৪৫ ভাগ সাধারণ চাকরি প্রার্থী।
দুই, চার, পাঁচ কিংবা দশ না। গুনে গুনে ৫৬% শতাংশ কোটা রয়েছে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে। এই অদ্ভূত বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীরা আওয়াজ তুলেছে। কিন্তু সে আওয়াজ রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের কর্ণকুহরে পৌঁছেনি, কিংবা পৌঁছলেও আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি।
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সরকারি নিয়োগে কোটাবৈষম্য নিরসনের দাবিতে ধীরে ধীরে রাজপথে নামতে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা। কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে উত্তপ্ত হয় ঢাবি, জবি, জাবি, রাবি, চবি, ইবিসহ দেশের প্রায় সকল পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। কেবল বিশ্ববিদ্যালয় কেনো দেশের প্রায় সবগুলো সরকারি বেসরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরাও একইভাবে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শণ করে। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনকে সমর্থন জানান দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবী মহল। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের পুলিশ দিয়ে দমানোর চেষ্টা করা হয়। বেশ কয়েক দফায় তাদের মিছিল, মানববন্ধন ও সড়ক অবরোধের কর্মসূচিতে পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল ও গুলি ছুড়েছে। আহত ও গ্রেফতার হয়েছে বহু সাধারণ শিক্ষার্থী।
পুলিশের নজিরবিহীন গুলি ও টিয়ারশেলে আহত হয় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী
সর্বশেষ গত ৮ এপ্রিল কোটা সংস্কারের দাবিতে গণ পদযাত্রার অংশ হিসেবে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। রাত আটটার দিকে তাদের ওপর হামলে পড়ে পুলিশ। রাতভর পুলিশ ও ছাত্রলীগের সাথে সংঘর্ষে আহত হন অন্তত দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী। টনক নড়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের। আলোচনার জন্য ডাকা হয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের। সময় চেয়ে নেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু তাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সম্মতি মেলেনি। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের চাপা আগুনে ঘি ঢালেন মতিয়া চৌধুরী। মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে আখ্যা দেন। এবং ঔদ্ধ্যত্যপূর্ণ বেশকিছু মন্তব্য করেন। ফুঁসে ওঠে কোটা বঞ্চনার শিকার ছাত্র সমাজ। সারাদেশে রাজপথে নেমে আসে তরুণ প্রজন্ম। বিকেলেই মহান জাতীয় সংসদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন –‘কোন কোটাই থাকবে না।’
প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা হতে পারতো সকল সমস্যার সমাধান। কিন্তু তা হলো না। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতদের আবারো দেখা গেল রাজপথে। তাই ঘুরে ফিরে জনমনে প্রশ্ন উঠছে- ‘প্রধানমন্ত্রী কি আন্দোলনরত শিক্ষার্থী তথা বৈষম্যের শিকার তরুণ প্রজন্মের সাথে প্রতারণা করলেন?’
মতিয়া চৌধুরীর অসংলগ্ন বক্তব্যে বিক্ষোভে ফেটে পরে শিক্ষার্থীরা
এ প্রশ্নটি মোটেও অপ্রসঙ্গিক কিংবা গুরুত্বহীন কিনা চলুন দেখে নেয়া যাক।
• শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ ও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে ৮ এপ্রিল দিবাগত রাতে ঢাবি ভিসির বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও নজিরবিহীন ভাংচুর চালানো হয়। এবং জাতীয় সংসদে এই কাজকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এমপি বক্তব্য দেন। প্রশ্ন হচ্ছে একটি নারকীয় তান্ডবকে কোন প্রকার তদন্ত ছাড়াই রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা কারো উপর চাপিয়ে দিতে পারেন কিনা? যদি না পারেন, তবে ধরেই নিতে হবে এখানে তাদের কোন বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে।
• বিষয়টা বক্তব্যে সীমাবদ্ধ থাকলে প্রতারণার প্রশ্ন আসতো না। কিন্তু ছাত্রদের আন্দোলন দমাতে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামী করে অন্তত চারটি মামলা করে পুলিশ। যা নিয়ে পরবর্তী সময়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উদ্বেগ ও আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছে। অবশ্য ঢাবি ভিসি স্বীকার করে নিয়েছেন যে, তার বাসভবনে হামলায় ঢাবির কোন শিক্ষার্থী জড়িত বলে তিনি মনে করেন না।
• আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আশঙ্কা অবশ্য অমূলক ছিল না। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া তিনজন শীর্ষ নেতাকে ঢাকা মেডিকেলের সামনে থেকে সাদা মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে গুম করার চেষ্টা করে সাদা পোষাকের ডিবি পুলিশ। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারার আশঙ্কায় তাদের ছেড়ে দেয় তারা।
• কোটা সংস্কারের দাবিতে যারা আন্দোলন করছে তারা সবাই ছাত্র। কিন্তু ছাত্রদের এই ন্যায্য দাবির বিপরীতে ছাত্রলীগ কেন বারবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো? যারা ছাত্রলীগ করে তারা কি ছাত্র নয়? তবে তারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে কার ইশারায় কেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে? তাদের উপর কার নির্দেশে গুলি ছুড়েছে? হলে হলে গিয়ে কার নির্দেশে আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে? এখনও পর্যন্ত কার নির্দেশে আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের হত্যার হুমকি দিচ্ছে?
• কোটা থাকবে না ঘোষণা দেয়ার পরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রজ্ঞাপন। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেয়ার পরও কার ইশারায় প্রজ্ঞাপন নিয়ে টালবাহানা করা হচ্ছে? সরকারের কোন মন্ত্রী বলছেন কোটা থাকবে, কোন মন্ত্রী বলছেন থাকবে না? আসলে সত্য কোনটি? প্রধানমন্ত্রী যদি সত্যিকার অর্থে কোটা বিলুপ্তির ঘোষণা দিয়ে থাকেন তবে প্রজ্ঞাপন জারি নিয়ে কেন এত গড়িমসি? কেন একেক সচিব একেক সময় একেক কথা বলছেন? এ সাহসই বা তারা কোথায় পাচ্ছে?
• সবশেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি বক্তব্য কোটা বিলুপ্তি নামে নতুন করে বড় ধরণের বৈষম্য সৃষ্টির ইঙ্গিত দিয়েছে। গত ১৩ মে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রজ্ঞাপন নিয়ে গড়িমসি সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন- ‘এখানে তো চিন্তা-ভাবনা আছে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী আছে, অনুন্নত জেলা আছে, মুক্তিযোদ্ধা আছে, নারী আছে, তাই এখানে একটি সুসমন্বিত কিছু করার চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে।’কথিত এই সুসমন্বিত কিছু করার নামে নতুন চেহারায় কোটা বৈষম্য ফিরে আসার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। আর যদি তাই হয় তবে, ‘কোন কোটাই থাকবেনা’ বলে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা কোটা বৈষম্যের শিকার তরুণ প্রজন্মের সাথে ‘ঐতিহাসিক প্রতারণা’ হয়েই থাকবে।
সংবিধানের ২৯ এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। ২৯ এর (২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হইবে না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।
এখন দেখার বিষয় প্রধানমন্ত্রী সংবিধানকে সমুন্নত রেখে জাতীয় সংসদে প্রদত্ত্ব নিজের বক্তব্য অনুযায়ী কোটা বৈষম্য দূর করতে পদক্ষেপ নিবেন? নাকি প্রজ্ঞাপন মুলা ঝুলিয়ে বৈষম্যের শিকার তরুণ প্রজন্মের সাথে প্রতারণা করবেন? যদি প্রতারণার আশ্রয় নিতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তবে বৈষম্য ও প্রতারণার শিকার তরুণ সমাজ কতটা বিক্ষোভে ফেটে পড়বেন তা সময় বলে দেবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন