ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শুরু হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরদার অভিযান। রবিবার দিনগত রাতেও র্যাব-পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে চিহ্নিত ৯ মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। এ নিয়ে গত ৬ দিনে মাদক ব্যবসায়ী নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ জনে। তবে বিশেষ অভিযানেও বন্ধ হয়নি ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা বড়িসহ সব ধরনের মাদকের
পাচার। ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তের ১১শ পয়েন্ট দিয়ে এখনো মাদক ঢুকছে দেদার। এর মধ্যে কক্সবাজারের ৪৯টি পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে ইয়াবা বড়ির বড় বড় চালান। মাদকের প্রবেশদ্বারগুলো খোলা রেখে এমন অভিযানের সফলতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করা হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত ৬ দিনে অন্তত ১৫ জেলায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছে। এতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাও ধরা পড়েছেন। ঘটেছে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণহানির ঘটনা। তবে ইয়াবার সদর দরজা হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার ও মাদকের অন্যতম প্রবেশদ্বার কুমিল্লা জেলায় এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান বড় কোনো অভিযান চোখে পড়েনি। ফলে এই জেলাগুলোর সীমান্তের ফাঁক গলে মাদকের চালান আসছেই।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে কোনো জেলা বাদ যাবে না। সীমান্ত গলে যেন মাদকের চালান ঢুকতে না পারে এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে বিশেষ নির্দেশনাও দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে মাদকের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার, কুমিল্লা, বান্দরবান, যশোর, ফেনী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো জেলা ঘিরে বিশেষ অ্যাকশন প্লান হাতে নেওয়ার কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারা বলছেন, জেলাগুলোর ওপর বিশেষ নজরদারি শুরু হয়েছে। এসব জেলা দিয়ে মাদক পাচার বন্ধ করতে পারলে মোটাদাগে সুফল পাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, কয়েক বছর আগেও প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তের সাড়ে ৫শ পয়েন্ট দিয়ে মাদকদ্রব্য প্রবেশ করত। বর্তমানে ১১শ পয়েন্ট দিয়ে মাদকদ্রব্য ঢুকছে। এর মধ্যে কক্সবাজারেই ৪৯টি। কক্সবাজারের সাগরপথ, সড়কপথ ও বান্দরবানের গহিন পাহাড় হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে এ ঘাতকবড়ি। ভারত সীমান্ত হয়ে ফেনসিডিল, কোকেন, হেরোইন প্রভৃতি মাদক ঢুকছে। আবার বাংলাদেশ সীমান্ত ব্যবহার করে ভারতেও ঢুকছে ইয়াবা ট্যাবলেট। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের তালিকভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী আক্তার কামাল, সাবেক ওসিপুত্র নিপু, সাইদ কামাল, ইউপি সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন ঝানু, ইউপি সদস্য সামছু, জালিয়াপাড়ার মৌলভী মজিবুর রহমান, সালমান, জুবায়ের, হাসান আলী, টিটি জাফর, গফুর, মাহাছোন, টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহম্মেদ, তার ছেলে শাজাহান মিয়া, দিদার, জিয়াউর রহমান, আব্দুর রহমান ইকরাম, রফিক, ইউপি সদস্য আব্দুল্লাহ, মৌলভী আজিজ, মৌলভী রফিক, মাঝিপাড়ার ইউপি সদস্য এনামুল হক, ভুট্টুসহ আরও বেশ কয়েক শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীর মাধ্যমে সারাদেশে ইয়াবা বড়ি ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে মৌলভী মজিবুর রহমান স্থানীয় এমপি বদির ছোট ভাই, নিপু এমপির ভাগ্নে। এসব তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই।
এদিকে মাদক নির্মূলে র্যাব-পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে মাদক ব্যবসায়ীরা নিহত হওয়ার ঘটনার সমালোচনা করে আসছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন আমাদের সময়কে বলেন, আইনের মধ্য থেকে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীÑ এটাই আমাদের চাওয়া; কিন্তু ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে ভালো কিছু হবে না। কারণ আইনবহির্ভূত একটি হত্যাকা-, আরেকটি অপরাধের জন্ম দেয়। ঘোষণা দিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যার প্রয়োজন পড়ে না। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও মানুষকে সচেতন করার মধ্য দিয়ে মাদক নির্মূল করতে হবে। বিশেষ করে সামাজিক শক্তি কাজে লাগাতে হবে।
গত ৬ দিনে র্যাব-পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময়ের ঘটনায় অন্তত ২২ শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে র্যাবের হাতে ১৩ জন এবং ৯ জন পুলিশের হাতে নিহত হন। পুলিশ প্রথমদিকে বন্দুকযুদ্ধে না জড়ালেও র্যাবের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে ৯ জন নিহত হওয়ার পর পুলিশও একই পথে হাঁটতে শুরু করে। র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদক নির্মূলে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটাতে চান। সেটি করতে গিয়ে যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা মূলত আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ বোঝাতে গুলিবিনিময় পর্যন্ত কঠোরতাকে বোঝাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সীমান্ত জেলাগুলোয় মাদকের ডিলার, খুচরা ব্যবসায়ী ও পৃষ্ঠপোষকদের নিয়ে তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত; কিন্তু অভিযানের ক্ষেত্রে কোনো কিছুই বিবেচনায় নিতে চাচ্ছেন না তারা। এ ছাড়া মাদকসেবী ও খুচরা মাদক ব্যবসায়ীদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক জেল-জরিমানা দেওয়া হচ্ছে। গত ৪ মে থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫৪৭ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের বিশেষ এই অভিযান চলমান থাকবে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলো স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে এবং বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ক্রসফায়ার তো ঠিক না। তবে মাদকে তো দেশ ছেয়ে যাচ্ছে এটাও বাস্তবতা। মামলা-মোকদ্দমা ঠিকমতো হচ্ছে না। তাহলে এদের নিয়ন্ত্রণ করা হবে কীভাবে? আসল যে হোতা তাদের তো ধরা যাচ্ছে না। তাদের ধরা হোক।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভিক্টিমলোজি অ্যান্ড রেস্টোরেটিভ জাস্টিস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, এ ধরনের বিশেষ অভিযান সাধুবাদযোগ্য। তবে মাদকের উৎস বা প্রবেশমুখ বাদ দিয়ে অভিযান পরিচালনা করলে সেটি সফল হবে না। অনেক জায়গাতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে মাদকের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এই দিকটিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। তা না হলে এটি শুধু লোকদেখানো অভিযানে পরিণত হতে পারে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্থলপথের পাশাপাশি নৌ ও সাগরপথেও দেদার ইয়াবা পাচার হচ্ছে। সাগরপথে ইয়াবা পাচারে বড় সুবিধা হলোÑ কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সমুদ্রসৈকতে প্রশাসনের তল্লাশি চৌকি কিংবা নিয়মিত টহল নেই বললেই চলে। এ ছাড়া অপ্রতুল জনবলের কারণেও এত দীর্ঘ সৈকতজুড়ে সে কাজ বিজিবি বা কোস্টগার্ডের পক্ষে কষ্টসাধ্যও বলে তারা জানিয়েছেন। এ ছাড়া প্রতিদিন শতশত ট্রলার সাগরে মাছ শিকারে গেলেও কোনটি মাছ নিয়ে কূলে ভিড়ছে আর কোনটি ইয়াবার চালান নিয়ে তা শনাক্ত করা কঠিন। এ সুযোগে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ইয়াবা পাচারকারীরা প্রতিনিয়ত লাখ লাখ ইয়াবার চালান পাচার করছে। মিয়ানমার থেকে ফিশিং ট্রলারে ইয়াবার চালান বঙ্গোপসাগরের সেন্টমার্টিন দ্বীপের কাছাকাছি এসে বাংলাদেশি ট্রলারে হাতবদল হয়। এরপর ইয়াবা বহনকারী এদেশীয় ফিশিং ট্রলারগুলো সুযোগ বুঝে কক্সবাজার থেকে শাহপরীর দ্বীপ সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে কূলে ভিড়ে নিরাপদে ইয়াবার চালান খালাস করে।
সাগরপথে পাচার হয়ে আসা ইয়াবার বড় চালান খালাস হয় টেকনাফ সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ, কাটাবনিয়া, খুরের মুখ, মুন্ডার ডেইল, বাহারছড়া, টেকনাফ সদরের খোনকারপাড়া, মহেষখালিয়াপাড়া, পর্যটন মোড়, হাবিরছড়া, রাজারছড়া, বাহারছড়া ইউনিয়নের নোয়াখালীপাড়া, শামলাপুর, শীলখালী ও উখিয়ার ইনানী।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন