রাজধানীর কাওলায় সিভিল এভিয়েশনের কোয়ার্টারে বাস করেন মো. টিটু। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার শিরগ্রামে। ইতালিরও নাগরিক তিনি। তৈমুর মানি এক্সচেঞ্জ, মহুয়া হোটেলের কর্ণধার। কোনো মামলা নেই তার নামে। তবে পুলিশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে- তৈমুর একজন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। চট্টগ্রাম থেকে নিয়মিত ইয়াবা এনে অন্যদের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন তিনি। অতি সম্প্রতি রাজধানীকেন্দ্রিক মাদকের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করেছে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। সেই তালিকায় তৈমুরের মতো 'হোয়াইট কালার' মাদক ব্যবসায়ীর নাম যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে এক ডজনের ওপর মামলার আসামিরাও। পুলিশ-র্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে রাজধানীর তালিকাভুক্ত শীর্ষ ৮২ ব্যবসায়ীকে খোঁজা হচ্ছে। সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হলে ঢাকাকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসার জাল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে অনেকটা।
রাজধানীকেন্দ্রিক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের এ তালিকার সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে গতকাল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন।
সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। সর্বশেষ গত রোববার গণভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেভাবে জঙ্গিবাদ দমন করা হয়েছে, তেমনি মাদক থেকেও দেশকে উদ্ধার করা হবে।
গত ৪ মে থেকে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করে র্যাব। এ ছাড়া পহেলা রমজান থেকে দেশজুড়ে পৃথকভাবে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। হঠাৎ করেই মাদক প্রতিরোধে সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থান নিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অতীতে বিভিন্ন সময় অভিযান হলেও কখনও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এত কঠোর অবস্থান দৃশ্যমান হয়নি। অভিযান শুরুর পর থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ-র্যাবের 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন ২২ মাদক ব্যবসায়ী। র্যাব গ্রেফতার করেছে ২ হাজার ৪৭১ জনকে। এ সময় প্রায় ২৮ কোটি টাকার মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়। এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ৬৩ লাখ ৯ হাজার ৩৬০টি ইয়াবা বড়ি জব্দ করে। ফেনসিডিল আটক করেছে ১ লাখ ৩৫ হাজার ২২৬ বোতল।
তালিকায় যারা :রাজধানীর ৪৯ থানা এলাকায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে যারা তালিকাভুক্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন বনানীর বড় বাজার কড়াইল বস্তির মো. বাবা কাসেম। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বনানী থানায় ১৬টি মাদক মামলা রয়েছে। বনানীতে কড়াইল বস্তি ঘিরে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকার মাদক ব্যবসা করে আসছেন বাবা কাসেম। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। তালিকায় আছেন ভাটারার বাসিন্দা সালাউদ্দিন। তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জের কাজলাকাঠি গ্রামে। গুলশান থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এ তালিকায় আছেন ভাটারার রাজু আহম্মেদ। তার বাসা নূরের চালায়। রাজুর বিরুদ্ধে গুলশান ও ভাটারায় ১২টি মামলা আছে। তালিকায় রয়েছেন মধ্যবাড্ডার আদর্শনগরের মোশাররফ হোসেন ওরফে পিচ্চি মোশাররফ। তার গ্রামের বাড়ি নবাবগঞ্জের রাজপাড়ায়। তার বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় সাতটি মামলা রয়েছে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে আছেন খিলক্ষেতের বেপারীপাড়ার নাজমা ইসলাম। তার বিরুদ্ধে মামলা আছে ২৩টি। এ তালিকায় আছেন ক্যান্টনমেন্টের মাটিকাটার বাসিন্দা জামাল সরদার। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের গোসাইরহাটে। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে ১০টি। শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী হলেন উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের মো. মহসিন। তিনি একটি মানি এক্সচেঞ্জের মালিক। তার বিরুদ্ধে মামলা নেই কোনো থানায়। তাকে 'হোয়াইট কালার' মাদক ব্যবসায়ী বলছে পুলিশ। এ তালিকায় আছেন উত্তরখানের কান্দাইল বাড়ি এলাকার মোবারক হোসেন। তার বিরুদ্ধে উত্তরা-পূর্ব, উত্তরখান ও দক্ষিণখান থানায় ছয়টি মামলা আছে। এ তালিকায় আছেন দক্ষিণখানের গুদারাঘাটের মোশাররফ হোসেন। এ ছাড়া শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা হলেন তুরাগের বটতলার জয়নাল আবেদীন। তার বিরুদ্ধে মামলা আছে নয়টি। এ তালিকায় আছেন কাফরুলের 'সি' ব্লকের রফিকুল ইসলাম রুবেল, পল্লবীর ১১ নম্বর সেকশনের মোস্তাক। মোস্তাকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তিনটি। তালিকায় আছেন ভাসানটেকের স্বপ্না। তার বিরুদ্ধে মামলা আছে আটটি। তালিকায় আছেন শাহআলীর নিউ 'সি' ব্লকের ফাতেমা। তার বিরুদ্ধে মামলা আছে চারটি। রূপনগরের দুয়ারীপাড়ার সালেহা বেগমও শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৮টি। এ তালিকায় রয়েছেন মিরপুরের জাহানারা বেগম। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তালিকায় আছেন মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের নাদিম ওরফে পঁচিশ। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা রয়েছে। তালিকায় আছেন কাফরুলের জ্যোৎস্না বেগম, কমলাপুরের জমিলা খাতুন, আরামবাগের সাইফুল হাসান মামুন, মানিকনগরের মঞ্জু হোসেন নিজু। নিজুর বিরুদ্ধে মুগদা থানায় মামলা রয়েছে পাঁচটি। তালিকায় আছেন রামপুরার রাবিক হাসান নিবিড়। তার গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে। তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে নয়টি। তালিকার অন্যরা হলেন খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগের নূর মোহাম্মদ, দক্ষিণ বাসাবোর সাফিয়া আক্তার শোভা। শোভার বিরুদ্ধে মামলা আছে ১৬টি। এ তালিকায় রয়েছেন নয়াপল্টনের ইফতেখার জামান জয়। তাকে মদদ দিচ্ছেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তালিকায় আছেন লালবাগের ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেনের ছোট ভাই মহসীন আজাদ, বংশালের কাশেম। কাশেমের বিরুদ্ধে কামরাঙ্গীরচর থানায় মামলা রয়েছে ১৬টি। তালিকায় আছেন কামরাঙ্গীরচরের মাদবর বাজারের মো. রকি, সূত্রাপুরের অজয় কুমার শীল, কোতোয়ালির পারুলী রানী, বংশালের জাহাঙ্গীর আলম, ওয়ারীর আবুল বাসার, ডেমরার আবদুস সামাদ ওরফে আজাদ ওরফে ঝুনু, শ্যামপুরের আশিকুজ্জামান, যাত্রাবাড়ীর ওয়াসা কলোনির সুফিয়া আক্তার, কদমতলীর মগা সুমন, গেণ্ডারিয়ার রবিন ওরফে হৃদয়, রমনার মো. রাজু, কাঁঠালবাগানের জাহিদ ওরফে টাইগার বাবু, নিউমার্কেটের শাহিনুর বেগম ওরফে মিনারা। মিনারার বিরুদ্ধে নিউমার্কেট থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ১৫টি মামলা রয়েছে। তালিকায় আছেন ধানমণ্ডির আবদুস সালাম, হাজারীবাগের বাপ্পী, সেগুনবাগিচার সেলিনা আক্তার কেয়া, মোহাম্মদপুরের ইসতিয়াক ওরফে কামরুল। তিনি সমাজসেবক ও দানবীর হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া তালিকায় আছেন উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ফজলুল করিম, বাড্ডার আফতাবনগরের রিয়াদ উল্লাহ, বংশালের নাছির উদ্দিন, নিউমার্কেটের আসমা আহম্মেদ ডালিয়া, বিজয়নগরের কামাল হোসেন, ছাব্বির হোসেন, যাত্রাবাড়ীর মোবারক হোসেন বাবু, ভাটারার আনোয়ারা বেগম, নার্গিস ওরফে মামি ওরফে সকার বউ, ধানমণ্ডির শামীম আহম্মেদ পাখানি, যাত্রাবাড়ীর রহিমা বেগম, মিরপুরের নজরুল ইসলাম নজু, মুগদার পারভীন, শফিকুল ইসলাম ওরফে মলাই, ডেমরার রাজু, কদমতলীর আলম হোসেন, মতিঝিলের লিটন, চকবাজারের ওমর ফারুক, কলাবাগানের নাজমুস সাকিব, কামরাঙ্গীরচরের খুরশিদা, তাজমহল রোডের শহীদুজ্জামান নাভিদ, শাহবাগের শামীম শিকদার, পারভীন আক্তার, উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরের গোলাম সামদানী ফিরোজ, উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের এনায়েতুর করিম, বাড্ডার শরিফ ভুঁইয়া আকিক, ভাটারার সাহিদা বেগম ইতি, কারওয়ান বাজারের মাহমুদা খাতুন, মিনা বেগম, বংশালের কাশেম, সেলিম ও সূত্রাপুরের হানিফ হোসেন উজ্জ্বল।
একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, শিগগিরই এই তালিকার পরিধি বাড়তে পারে। আরও বেশ কয়েকজন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর ব্যাপারে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। চলমান অভিযানে চুনোপুঁটি থেকে রাঘববোয়াল- সকল মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধু সদস্যসহ অন্য যারা মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন, তাদেরও আইনের আওতায় নেবে পুলিশ। জঙ্গিবাদের পর মাদক ব্যবসার চক্র রোধ করাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বাংলাদেশে মাদক উৎপাদন না হলেও বাংলাদেশকে মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন মাদক ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের বিমান, নৌ ও স্থলপথে কোটি কোটি টাকার মাদক পাচার হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। সীমান্তের অন্তত ৬৭টি পয়েন্ট সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকেও মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওসকে নিয়ে গঠিত 'গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল'; ভারত, নেপাল ও তিব্বতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে 'গোল্ডেন ওয়েজ' এবং পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে 'গোল্ডেন ক্রিসেন্ট' বাংলাদেশের কাছাকাছি হওয়ায় বাংলাদেশ মাদক আগ্রাসনের ঝুঁকির মধ্যে।
গত রোববার ডিএমপি কমিশনারের সভাপতিত্বে রাজধানীকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসা প্রতিরোধে করণীয় নিয়ে শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন। সেখানে বলা হয়, মাদক ব্যবসা প্রতিরোধে সর্বোচ্চ কঠোর নীতি গ্রহণ করেছেন তারা। সীমান্ত হয়ে যেসব মাদক দেশে ঢোকে, তার একটি বড় অংশ আসে রাজধানীতে। তাই ঢাকাকে মাদকমুক্ত করা জরুরি।
ডিএমপির ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) কৃষ্ণপদ রায় সমকালকে বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। যে কোনো মূল্যে সমাজকে এই ভয়ঙ্কর থাবা থেকে মুক্ত করা হবে। প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, মাদক ব্যবসার সঙ্গে কে জড়িত, তার পরিচয় মুখ্য নয়। তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে যে কাউকে আইনের আওতায় আনা হবে। নারী মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও নজরদারি অব্যাহত আছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা জানান, পুলিশ-র্যাবের মতো তাদের হাতে অস্ত্র না থাকলেও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মাদক প্রতিরোধে সাধ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার করছেন তারা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন