ইথেফোন নামে এক ধরনের উপাদান দিয়ে পাকানোয় তিন হাজার মণ আম ক্ষতিকর দাবি করে ধ্বংসের পাশাপাশি কারাদণ্ড হয়েছে ২৪ জনের। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক জানিয়েছেন, এই উপাদান মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়।
ইথেফোন সারা পৃথিবীতেই ফল পাকাতে ব্যবহার করা হয়। ২০১০ সালে ভারতের উত্তরপ্রদেশে কৃত্রিমভাবে ফল পাকানোর বিরুদ্ধে অভিযানের পর বিতর্ক উঠলে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এর ব্যবহার অবৈধ নয়। ভারত সরকার ফল ও টমেটো পাকাতে এই হরমোনের ব্যবহার বৈধ করেছে।
কিন্তু বাংলাদেশে যারা অভিযান চালাচ্ছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই। অথচ ফল ধ্বংসের পাশাপাশি ব্যাপকহারে ফল ব্যবসায়ীদের নানা মেয়াদে সাজাও দিয়ে দিচ্ছেন অভিযান পরিচালনাকারীরা।
কৃত্রিমভাবে ফল পাকাতে এক সময় ব্যাপকভাবে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার হতো। ২০০৫ সালের পর থেকে ব্যাপকভাবে ভেজালবিরোধী অভিযান শুরুর পর এই বিষয়টি সামনে আসে। তবে গত কয়েক বছর ধরে এই উপাদানটির বদলে ব্যাপকভাবে ইথ্রেল বা ইথেফোন ব্যবহার করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এনভায়রমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি বলছে, বিভিন্ন ফসলের গাছের বৃদ্ধি, ফল পাকানো, গাছে ফুল আনতে এবং অন্যান্য নানা কারণে ইথেফোন ব্যবহার করা হয়। এর মিশ্রণ ঘরোয় সবজি বাগানে হাতে করেও স্প্রে করা হয়।
১৯৬৫ সালে এটি উদ্ভাবন হয় এবং বাণিজ্যিকভাবে এর ব্যবহার শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। এমচেম এবং ইউনিয়ন কার্বাইড কোম্পানি একে গাছের বৃদ্ধিকারী উপাদান হিসেবে ব্যবহার করত।
ভারতের পাঞ্জাব এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটির শিক্ষক বি ভি সি মহাজন রিসার্চ গেট নামে একটি ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে লেখেন, ‘ইথালিন নামে একটি হরমোনের কারণে স্বাভাবিকভাবে ফল পাকে। এটি গাছেই তৈরি হয়। ইথালিন তৈরির বাণিজ্যিক মিশ্রণ হচ্ছে ইথ্রিল বা ইথেফোন। এটি পানিতে মেশালে ইথাইলিন তৈরি করে। ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহারের ভালো বিকল্প এটি। ভারতে ব্যাপকভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যেখানে ফল পাকাতে ব্যাপকভাবে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করে, সেখানে ইথাইলিন নির্ভর রাসায়নিকের ব্যবহারকে উৎসাহী করা উচিত।’
ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য বিপজ্জনক। এতে অল্প পরিমাণে দুটি বিষাক্ত উপাদানের মিশ্রণ থাকে। এগুলো হলো আর্সেনিক এবং ফসফরাস।
সাধারণত ক্যালসিয়াম কার্বাইড পানিতে মিশিয়ে তাতে ফল ডুবিয়ে তুলে নিয়ে রেখে দিলে দুই এক দিনের মধ্যে ফল পেকে যায়। তবে এটি একটি বিপজ্জনক প্রক্রিয়া।
এ ধরনের কাজে যে কোনো সময় আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এছাড়া আর্সেনিক ও ফসফরাসযুক্ত কার্বাইড ফলের আবরণ বা ফলের ভেতর ঢুকে গেলে বিপদের কারণ ঘটাতে পারে।
আবার কার্বাইডমিশ্রিত পানি ফলের ওপর ছিটিয়ে দিয়ে পাতা বা খড় দিয়ে ঢেকে রেখে অল্প সময়ে ফল পাকিয়ে ফেলে এটাও বিপজ্জনক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মুনিরউদ্দিন আহমেদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ইথেফোনের জলীয় দ্রবণ বা ইথাইলিন গ্যাসের মাধ্যমে ফল পাকানো নিরাপদ।
ইথ্রেল বা ইথেফোনের জলীয় দ্রবণ সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ইথাইলিন গ্যাস উৎপন্ন করে যা ফল পাকাতে সাহায্য করে। এ পদ্ধতিতে ফল পাকালে বিপদের ঝুঁকি থাকে না।
অধ্যাপক মুনির বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত অনিরাপদ রাসায়নিক দিয়ে অপরিপক্ব আম পাকানোর অভিযোগে আম ধ্বংস করা হচ্ছে। কিন্তু ঘটনাটি নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে আম ও অন্যান্য ফল খাওয়া নিয়ে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। এটা ঠিক হচ্ছে না।’
গত ১৫ মে কাওরানবাজারে ফলের আড়তে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ৪০০ মণ আম ধ্বংসের পাশাপাশি আটজনকে কারাদণ্ড ১৭ মে যাত্রাবাড়ীতে এক হাজার মণ আম ধ্বংসের পাশাপাশি নয় জনকে কারাদণ্ড, ১৯ মে মিরপুরে এক হাজার ২০০ মণ আম ধ্বংসের পাশাপাশি ছয় জনকে কারাদণ্ড এবং ২১ মে কারওয়ানবাজারে অভিযান চালিয়ে আরও চারশ মণ আম ধ্বংসের পাশাপাশি এক জনকে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
ভারতে ফল ও টমেটো পাকানোর জন্য ইথেফোন বা ইথ্রেল ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে সে দেশের সরকার। তামিলনাড়ুতে বিজ্ঞানীরা ফল ও টমেটো পাকানোর জন্য একটি পদ্ধতি বের করেছেন। তারা একটি বড় পাত্রে পাঁচ লিটার পানিতে ১০ মিলিলিটার ইথেফোন এবং দুই গ্রাম সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড মিশিয়ে বদ্ধঘরে রাখা ফল বা টমেটোর পাশে রেখে দেন। আর ইথেফোনের মিশ্রণ থেকে উৎপাদিত ইথাইলিন গ্যাস দ্বারা ফল বা টমেটো পেকে যাবে। এতে বিন্দুমাত্র ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না।
ভারতের প্রখ্যাত কৃষিবিজ্ঞানী ড. সঞ্জীব কুলকার্নি ২০১৭ সালের ১৪ এপ্রিল টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফল পাকাতে ক্ষতিকর ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার না করে ইফ্রিল বা ইথাইলিন ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন।
অধ্যাপক মুনিরউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের কৃষকদের ফল বা টমেটো পাকানোর সঠিক পদ্ধতি শেখানো হয় না বলে যত সমস্যার উৎপত্তি। আমরা হয়তো জানি না, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকানো হয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকানো হয়।’
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে কাঁচা সবুজ রঙের কলা আমদানি করে গুদামজাত করা হয়। পরবর্তীকালে এসব কাঁচা কলাতে ইথাইলিন গ্যাস স্প্রে করা হয়। দুয়েকদিনের মধ্যে কলা পেকে যাওয়ার কারণে বাজারজাত করা সম্ভব হয়।’
যেসব অভিযানে আম ধ্বংস করা হয়েছে, সেসব অভিযানে র্যাব বা পুলিশের সঙ্গে ছিল মান নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইএর কর্মকর্তারাও। বিস্ময়কর হলো সংস্থাটির মান নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক এস এম ইসহাক আলীই ইথেফোনের বিষয়টি জানেই না।
বিএসটিআই এর পরিচালক বলেন, ‘ইথেফোন দেখা বিএসটিআইয়ের কাজ না। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আছে, তারাই দেখতে পারে। ইথেফোন নির্ণয় করার উপায় আমাদের এখানে জানা নেই। এই কেমিকেল ব্যবহারের স্ট্যান্ডার্ড নেই যে কতটুকু ব্যবহার নিরাপদ।’
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য ও যুগ্ম সচিব মাহবুব কবির বলেন, ‘ইথেফোন পরীক্ষা করার উপায় নেই। আর এটা ব্যবহারের মাত্রাও নির্ধারিত নেই। কিন্তু সময়ের আগে আম এনে কেমিকেল দিয়ে পাকিয়ে বাজারে বিক্রি করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে।’
‘এই কেমিক্যাল দিয়ে আম পাকালে বাইরে টসটসে হলুদ বর্ণের হয়ে যায়। কিন্তু ভেতরে একদম কাঁচা থাকে। ব্যবসায়ীদের ধরার পর তারা স্বীকার করছে যে আম ইথেফোন দিয়ে পাকাচ্ছে।’
কৃষি তথ্য সার্ভিসের মতে, ইথেফোন হলো টু ক্লোরোইথেন ফসফরিক এসিড, যা একটি প্লান্টগ্রোথ হরমোন। তবে পরিপক্ব ফলকে পাকাতে এবং সংরক্ষণে এর ব্যবহার প্রচলন সারা পৃথিবীতে রয়েছে। গবেষকেরা বিভিন্ন মাত্রায় (২৫০-১০০০০ পিপিএম) ইথেফোন পরিপক্ব কাঁচা আমে স্প্রে করার ২৪ ঘণ্টা পর এর উপস্থিতির মাত্রা নির্ণয় করতে গিয়ে দেখতে পান, এটি দ্রুত ফলের উপরিভাগ থেকে উড়ে যায়। তবে যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তা নির্ধারিত গ্রহণযোগ্যতা মাত্রার (এমআরএল-টু পিপিএম) অনেক নিচে নেমে যায়।
তবে আম চাষিরা যেন অতিরিক্ত মাত্রায় ইথেফোন ব্যবহার না করেন এবং তা কেবল পরিপূর্ণ পুষ্ট কাঁচা আমে ব্যবহার করেন সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দান ও ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন কৃষি বিজ্ঞানীরা।
কেননা অপরিপক্ক আম ইথেফোন দিয়ে পাকালে সেটির পুষ্টিগুণ অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যায়।
যে উপাদান ব্যবহার ক্ষতিকর নয়, সেটি ব্যবহারের দায় আম ধ্বংস বা মানুষকে কারাদণ্ড কেন দেয়া হচ্ছে- এমন প্রশ্নে একাধিক অভিযান চালানো র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারোয়ার আলম ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘শুধু ইথেফোন নিয়ে অভিযান নয়। এখানে দুটো বিষয় আমরা কাজ করি। মনে রাখতে হবে কখনও কেমিক্যাল প্রত্যাশিত নয়।’
‘তারপর কিছু কিছু কেমিক্যাল অনুমোদিত নয়। এখানে ক্যালসিয়াম কার্বাইড অনুমোদিত নয়। নিরাপদ খাদ্য অধিকার আইনের ১৩ অনুচ্ছেদ এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আমে ইথেফোন ও কার্বাইড ক্যালসিয়াম দুটোই ব্যবহার করে।’
এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মতে ‘ইথেফোন নিয়ে দুটো চিন্তা আছে। এক ধরনের বিজ্ঞানীরা বলেন, এটা ফলে দিলে উড়ে যায়। আবার আরেক বিজ্ঞানীরা বলেন এটা করা ব্যবহার করা যাবে না। এমনকি ইথেফোন যে কোম্পানি তৈরি করেছে তারা বলে দিয়েছে এটা ফল পাকাতে ব্যবহার করা যাবে না। তার মানে এটা অবশ্যই শরীরের ক্ষতি করে।’
‘যদি আমরা এখানে ইথেফোন অনুমোদন দিয়ে দেই তাহলে দেখা যাবে তারা ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করবে। তখন সকল খাবারে অন্য কেমিকেল ব্যবহার শুরু করেছে।’
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন