মাথার ওপর থেকে সন্ত্রাসীদের ছায়া সরে যাচ্ছে। ছায়া হিসেবে থাকা গডফাদার কিংবা বড় ভাইরা এখন নিজেদেরই গুটিয়ে নিচ্ছেন। সম্প্রতি আন্ডারওয়ার্ল্ডে এক ধরনের কঠোর বার্তা পৌঁছেছে। এই বার্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এক ধরনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। যে কারণে গডফাদাররা নিজেদের গা বাঁচাতে আড়ালে চলে যাচ্ছেন। এর ফলে সন্ত্রাসীরা তাদের গডফাদারের আশ্রয় হারাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বর্তমানে মাদক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের যে কঠোর পদক্ষেপ তা থেকেও বার্তা গেছে অপরাধীচক্রের কাছে। আর এসব অপরাধীকে যারা ছত্রছায়া দিয়ে থাকেন তাদের জন্য আগামীতে থাকছে দুঃসংবাদ। ইতিমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসী তালিকা হালনাগাদ শুরু হয়েছে। তালিকায় প্রাধান্য পাচ্ছে সন্ত্রাসীদের গডফাদারের নাম।
জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে সন্ত্রাসী তালিকা হালনাগাদ চলমান প্রক্রিয়া হলেও অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে একটি নির্ভুল তালিকা তৈরির কাজ চলছে। থানা এলাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আড়ালে থাকা সন্ত্রাসী এবং গডফাদারদের যে তালিকা তৈরি হচ্ছে এতে রাজনৈতিক পরিচয় প্রাধান্য পাচ্ছে না। অপরাধের মাত্রা, ধরন এবং অপরাধী ব্যক্তির বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড তুলে আনা হচ্ছে মাঠ পর্যায়ের গোয়েন্দা সদস্যের মাধ্যমে। পরিস্থিতি অনেকটা আঁচ করতে পেরে গডফাদারদের অনেকে তাদের শিষ্যদের দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
মাঠে কাজ করছেন এমন এক দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সদস্য বলেন, ঢাকায় গডফাদারদের বাড়িতেই বৈঠকখানা আছে। রাত গভীর হলে এসব বাড়িতে লোকজনের আসা-যাওয়া বাড়তে থাকে। অনেকের আছে রাজনৈতিক পরিচয়ও। তিনি জানান, যদিও সন্ত্রাসী বা অপরাধীদের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রাধান্য দেয় না তবুও বেশিরভাগ গডফাদারের কোনো না কোনো রাজনৈতিক পরিচয় আছেই। তারা রাজনৈতিক দলের আড়ালে পালিত সন্ত্রাসী, পালিত ক্যাডার ও শিষ্য তৈরি করেন। অনেকের আছে নিজস্ব শুটার বাহিনী। কারো কারো বৈধ অস্ত্রের আড়ালে অবৈধ অস্ত্র আছে কী না সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, গডফাদার ছাড়া রাজধানীতে শ্রেণিভেদে ছোট-বড় ও মাঝারি এই তিন স্তরে সন্ত্রাসী রয়েছে। শ্রেণি বিন্যাস হওয়া সন্ত্রাসীদের এলাকাও ভাগ করা আছে। তাদের বিরুদ্ধে আছে হত্যা মামলা, ডাকাতি, সশস্ত্র ছিনতাইসহ নানা ধরনের অভিযোগের ঘটনা। আছে নির্দেশদাতা, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গোলাগুলি সৃষ্টিকারী, টেন্ডারবাজ, ছিনতাই, ডাকাতি, মোবাইল ফোনে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন শ্রেণির সন্ত্রাসী। ইদানীং আন্ডারওয়ার্ল্ডে আবার বার্তা বাহক তৈরি হয়েছে। অবশ্য আগে এই বার্তা বাহকই তথ্য-আদান প্রদান করত। বর্তমানে প্রযুক্তি দক্ষ গোয়েন্দারা সন্ত্রাসীদের কথাবার্তা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জেনে যাওয়ায় সতর্কতা অবলম্বন করছেন অপরাধীচক্রের সদস্যরা। এ কারণে গডফাদাররা তাদের বার্তা বাহকের ওপর নতুন করে আস্থা রাখা শুরু করেছেন।
ঊর্ধ্বতন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা মানবকণ্ঠকে বলেন, জামিন পেয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হতে যাচ্ছে এ ধরনের সন্ত্রাসীদের ক্ষেত্রেও বিশেষ নজর আছে। বিভিন্ন কারাগারে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিজস্ব প্রতিনিধি আছে, যারা এ বিষয়ে সব সময় খোঁজখবর রাখেন। সম্প্রতি দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এদের মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কয়েক বছর আগে জামিন পেয়ে ফাঁকফোকর গলিয়ে বিদেশে পালিয়ে অবস্থান করছেন। আরেকজন সন্ত্রাসীর ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটার আগেই সতর্ক আছেন গোয়েন্দারা। এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীরও আছে গডফাদার।
এই কর্মকর্তা বলেন, বিকাশের ক্ষেত্রে একজন সাবেক মন্ত্রী ভূমিকা রেখেছিলেন বলে আন্ডারওয়ার্ল্ডে এখনো কানাঘুষা হয়ে থাকে। আরেকজনের ক্ষেত্রেও এক গডফাদার আছেন। গডফাদাররা অনেক ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে অপরাধীদের পার পাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
গোয়েন্দা সূত্রে আরো জানা গেছে, যারা চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী ও খুনিদের আশ্রয় প্রশ্রয়দাতা হিসেবে কাজ করছেন তাদের ব্যাপারেও জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল থাকবে সরকার। যেভাবে মাদক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, ঠিক একইভাবে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের জন্যও একই বার্তা আসছে। বিশেষ করে ঈদকে সামনে রেখে সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়। ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহল থেকে চাঁদা আদায় করে। কেউ না দিলে মৃত্যুর ভয় দেখায়। এ ধরনের অপরাধীদের জন্যও থাকছে কঠোর বার্তা।
সম্প্রতি রাজধানীর দক্ষিণ বাড্ডায় জাগরণী ক্লাব মাঠে কেবল অপারেটর আবদুর রাজ্জাক ওরফে ডিশ বাবু খুনের ঘটনার পর প্রবাসী গডফাদারের নাম এলেও এলাকার গডফাদারও আছে বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন। বাড্ডা এলাকায় চাঁদাবাজি, ডিস ব্যবসা, মাদক ব্যবসা, গরু হাটের ইজারার আধিপত্য নিয়ে একের পর এক ঘটনা ঘটেই থাকে। বাবু খুনের আগে আরো দুটি খুনের ঘটনায় গডফাদারদের আধিপত্যকে দায়ী করা হয়। এসব ঘটনাকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদক সন্ত্রাসের মতোই চাঁদাবাজ এবং আধিপত্য বিস্তারকারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এ কারণে আন্ডারওয়ার্ল্ডে শুরু হয়েছে নতুন হিসাব-নিকাশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রী, এমপি বা শাসক দলের ভেতরে থাকা অনেক নেতার নাম ব্যবহার করে যারা আন্ডারওয়ার্ল্ড সক্রিয় ছিলেন এবং অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী হিসেবে সরব থাকতেন তারাও গা-ঢাকা দিচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর ভেতরে দানা বেঁধেছে শঙ্কা। এখন অনেকের পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর পথ নেই। কারণ তাদের অনেকের মাথার ওপর গডফাদারের আর ছায়া থাকছে না।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (অপারেশন্স) শেখ নাজমুল আলম মানবকণ্ঠকে বলেন, সন্ত্রাসীদের তালিকা হালনাগাদ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ তালিকা হালানাগাদের মাধ্যমে দাগী অপরাধী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের কঠোর হস্তে দমন করা একটি রুটিন ওয়ার্ক। তিনি বলেন, সামনে নির্বাচনকে সামনে রেখেও গোয়েন্দারা সতর্ক রয়েছেন।
ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা ইঙ্গিত করে বলেন, চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যে কোনো ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক রয়েছে। এদের দমন করতে যে ধরনের কৌশল গ্রহণের প্রয়োজন তাই করা হবে। এ জন্য হালনাগাদ তালিকার মাধ্যমে সন্ত্রাসী ও তাদের গডফাদারদের দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় রয়েছে।
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন