বাইরে চাকচিক্য, ভেতরে প্রতারণার চিত্র! রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলোতে খেতে গিয়ে বিভ্রান্তির মুখে পড়ছেন গ্রাহকরা। মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবারের গায়ে মেয়াদ বাড়িয়ে নতুন স্টিকার লাগানো হয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন খাবারে ভেজাল মেশানো ছাড়াও মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার বিক্রির অভিযোগ। এ ধরনের কাজ গ্রাহকদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেকটাই হুমকিস্বরূপ। ঘটতে পারে প্রাণহানিকর ঘটনাও।
রাজধানীতে গড়ে ওঠা অনেক নামিদামি রেস্টুরেন্ট আর সুপারশপে গিয়ে প্রায়ই প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহকরা। বিভিন্ন খাবারে ভেজাল মেশানোর অভিযোগ ছাড়াও মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার বিক্রিরও প্রমাণ মিলছে অহরহ। মেয়াদ পেরুনো খাবারের গায়ে নতুন স্টিকার লাগিয়ে মেয়াদ বাড়ানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত অনেকে। আবার কেউবা বিক্রি করছেন পচা, বাসি, পোড়া তেলে ভাজা ও ভেজাল খাদ্য। যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে জানায় ভোক্তা অধিকার অধিদফতর ও র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ধানমণ্ডিতে কেএফসিকে অপরিশোধিত পানি ও তেল ব্যবহারের অভিযাগে বুধবার ১ লাখ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং কাপড়ের রং খাবারে মেশানোর দায়ে মেজবান রেস্তোরাঁকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এ ব্যাপারে ভ্রাম্যমাণ আদালতে নেতৃত্ব দানকারী র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, কেএফসিতে পানি ফিল্টারিং কাজ করছে না। ফলে লোকজন নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার কারণে মারাত্মক রোগ সৃষ্টি হতে পারে। দ্বিতীয়ত এখানে জর্দায় যে রং ব্যবহার করা হচ্ছে, তা টেক্সটাইল বা কাপড়ে ব্যবহার করা রং। যার কারণে মানুষের ক্যানসার হতে পারে।
তিনি আরো বলেন, কেএফসিতে একজন ভোজনবিলাসী অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে খাবার খাচ্ছেন। প্রাইস লিস্টে দেখলাম একটি চিকেন ফ্রাই তৈরিতে তাদের ৩১ টাকা ৭৫ পয়সা খরচ হয়, অথচ তারা ক্রেতাদের কাছে ১৩৯ টাকায় এটা বিক্রি করছেন। এত টাকা নেয়ার পরেও কেন তারা অপরিশোধিত তেল ও পানি দিয়ে রান্না করবে!
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, অনেক নামিদামি রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখেছি মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার বিক্রি করছে। তাদের জরিমানা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের জন্য ভেজালবিরোধী অভিযান অব্যাহত আছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরো সময় প্রয়োজন।
ভুক্তভোগী ক্রেতা নাজমুল হুদা জানান, খাবারের প্যাকেটে একটি স্টিকারের ওপর আরেকটি স্টিকার। একটি প্যাকেটের ডেট আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আরেকটি নতুন স্টিকার লাগিয়ে তিন দিন বাড়িয়ে নিচ্ছে। সবক’টি প্যাকেটের মধ্যে দুটি করে স্টিকার লাগানো। এটা একটা ক্রাইম। এমন ঘটনায় রেস্টুরেন্টে দায়িত্বরত সুপারভাইজাররা অনেক সময় নিজেদের ভুলও স্বীকার করেন।
এ ব্যাপারে বিএফসির সুপারভাইজার মোস্তফা হোসেন বলেন, আমি আমাদের ভুল স্বীকার করছি। এটা হয়তো ভুল করে আমাদের হেড অফিস থেকে অনেক সময় আসে। এটা বড় একটা অপরাধ।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক শফিকুল ইসলাম লস্কর বলেন, যেখানে মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার বা ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে জরিমানা করা হচ্ছে। কেউ যদি অভিযোগ করে এবং সেই অভিযোগের প্রমাণ মিললে যদি জরিমানা করা হয় তাহলে সেই জরিমানার অর্ধেক সেই অভিযোগকারী পায়। যদিও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন বলছে, ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে জরিমানা আদায় ও অভিযোগকারীকে সে জরিমানার ২৫ শতাংশ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়া হয়ে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, মেয়াদ উত্তীর্ণ বা ভেজালযুক্ত খাবার অনেক সময় প্রাণঘাতী হতে পারে। এ ধরনের খাবার খেলে ভয়ঙ্কর ডায়রিয়া হতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত দুই বছরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর এবং র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত এই দুটি সংস্থার জরিমানা আদায়ের পরিমাণ ১৭ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর- ২০১৬-১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৬১৪০টি অভিযোগের মধ্যে নিষ্পত্তি করে ৫৮০৪টি। আর এ থেকে জরিমানা আদায় করে ৬ কোটি ৮২ লাখ ১১ হাজার ৯২০ টাকা। অপরদিকে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ২০১৬-২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৮২৬টি অভিযানের মধ্যে ১২৪৬টি মামলায় মোট ৯ কোটি ৭০ লাখ ৫২ হাজার ৯শ’ টাকা জরিমানা আদায় করে।সংশ্লিষ্টদের দাবি নিয়মিত মনিটরিং তো বটেই, গ্রাহকদের সচেতনতাও পারে সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে।
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন