দেশে মাদকের ভয়াবহতা ও ব্যাপ্তি ঠেকাতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন রয়েছে। আইনটিতে মাদকের পরিমাণ অনুযায়ী শাস্তিও নির্ধারণ করা হয়েছে। আইনে কমপক্ষে দুই বছর থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে।
মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণার পর মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। তাই মাদকদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণে ‘বন্দুকযুদ্ধ’র নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড না ঘটিয়ে সুনির্দিষ্ট আইন অনুসারে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন,‘মাদক নিয়ন্ত্রণে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কোনও সমাধান নয়। দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন রয়েছে। এছাড়াও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মাদক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বলা আছে। সেখানে সর্বোচ্চ শাস্তিরও বিধান রয়েছে। তাই সরকারকে এ (শাস্তি) জায়গাটায় আরও গুরুত্ব দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন,‘মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনার সময় যদি কাউকে অপরাধী মনে হয়, সেক্ষেত্রে তাকে মেরে ফেলা বা ক্রসফায়ারে দেওয়ার কোনও সুযোগ আমাদের আইনে নেই। সেক্ষেত্রে অবশ্যই অপরাধীকে আইনের কাছে সোপর্দ করতে হবে এবং আইনের কাছে সোপর্দ করে তার বিচার নিশ্চিত করতে হবে।’ তাই প্রাষঙ্গিক আইন অনুসারে এসব অপরাধীর বিচার সঙ্গে সঙ্গে করা যায় কিনা, সে বিষয়ে সরকারকে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী সদস্য জেড আই খান পান্না মনে করেন,একদিকে যেমন মাদক নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন, তেমনি মাদক নিয়ন্ত্রণের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও নিন্দনীয় ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ করে মাদকমুক্ত সমাজ গড়া একান্ত দরকার। কিন্তু, সেটা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নয়। যারা মাদক সম্রাট,চোরাকারবারির সঙ্গে জাড়িত তারা কি একজনও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ পড়ছে? আদৌ না। তাদের নামও নেওয়া হয় না। পত্র-পত্রিকায় দেখি মাদকের চোরাচালানের মাধ্যমে যারা রাতারাতি ধনী হয়ে গেছে। বর্ডারে যারা আছে,তারা কি কেউ ধরা পড়েছে? আদৌ না। এমনকি তাদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদও হয়নি।’
জেড আই খান পান্না আরও বলেন,‘মাদক নিয়ন্ত্রণ ও এর বিচার করতে হলে এর গডফাদারদের ধরতে হবে। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে সারাদেশে যারা মাদকে কু-পরিচিত অন্তত তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে ধরতে হবে। বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে নয়,বিচারের সম্মুখীন করেই তাদের বিচার করতে হবে।’
মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে যা বলা আছে-
১৯৯০ সালের ২ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০। এরপর বেশ কয়েকবার আইনটিতে সংশোধনী আনা হয়। আইনটি ১৯ ধারায় মাদকদ্রব্য ব্যবহারের পরিমাণ ও এর দণ্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে-
হেরোইন, কোকেন এবং কোকা উদ্ভূত মাদকদ্রব্য-
এসব মাদকদ্রব্যের পরিমাণ অনূর্ধ্ব ২৫ গ্রাম হলে কমপক্ষে ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে এসব মাদকদ্রব্যের পরিমাণ ২৫ গ্রামের ঊর্ধ্বে হলে তার মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে।
প্যাথেড্রিন, মরফিন ও টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল-
এসব মাদকদ্রব্যের পরিমাণ অনূর্ধ্ব ১০ গ্রাম হলে কমপক্ষে ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড হয়ে থাকে। তবে মাদকদ্রব্যের পরিমাণ যদি ১০ গ্রামের ঊর্ধ্বে হয়,সেক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে।
অপিয়াম, ক্যানাবিস রেসিন বা (অপিয়াম উদ্ভূত,তবে হেরোইন ও মরফিন ব্যতীত মাদকদ্রব্য)-এসব মাদকদ্রব্যের পরিমাণ অনূর্ধ্ব ২ কেজি হইলে কমপক্ষে ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আর এর পরিমাণ ২ কেজির ঊর্ধ্বে হলে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
মেথাডন-
মাদকদ্রব্যের পরিমাণ অনূর্ধ্ব ৫০ গ্রাম হলে কমপক্ষে ২ বছর এবং অনূর্ধ্ব ১০ বছর কারাদণ্ড হতে পারে। কিন্তু এর পরিমাণ ৫০ গ্রাম এর ঊর্ধ্বে হলে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
গাঁজা বা যে কোনও ভেষজ ক্যানাবিস-
এসব মাদকদ্রব্যের পরিমাণ অনূর্ধ্ব ৫ কেজি হলে কমপক্ষে ৬ মাস এবং অনূর্ধ্ব ৩ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে এর পরিমাণ ৫ কেজির ঊর্ধ্বে হলে কমপক্ষে ৩ বছর এবং সর্বোচ্চ ১৫ বছর কারাদণ্ড হতে পারে।
যে কোনও প্রজাতির ক্যানাবিস গাছ-
ক্যানাবিস গাছের সংখ্যা অনূর্ধ্ব ২৫টি হলে কমপক্ষে ৬ মাস এবং সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর গাছের সংখ্যা ২৫টির বেশি হলে কমপক্ষে ৩ বছর এবং অনূর্ধ্ব ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
ফেনসাইক্লিআইন, মেথাকোয়ালন এল, এস, ডি, বারবিরেটস অ্যামফিটামিন (ইয়াবা তৈরির উপাধান) অথবা এইগুলির যেকোনটি দ্বারা প্রস্তুত মাদকদ্রব্য-
মাদকদ্রব্যের পরিমাণ অনূর্ধ্ব ৫ গ্রাম হলে কমপক্ষে ৬ মাস এবং সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড। আর মাদকদ্রব্যের পরিমাণ ৫ গ্রাম এর ঊর্ধ্বে হলে কমপক্ষে ৫ বছর এবং সর্বোচ্চ ১৫ বছর কারাদণ্ড।
মাদক ব্যবসায়ীসহ সন্ত্রাসীদের ধরে বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকারকর্মী ও ট্রান্সপারেন্সি বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি সুলতানা কামাল। তিনি বলেন,‘জনগণের টাকায় কেনা অস্ত্রের বেআইনি ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।’ ২১ মে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন