দীর্ঘ নয় বছরেও সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি আইলা দুর্গত এলাকার বাসিন্দারা। কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে ব্যর্থ হয়েছেন দুর্গতরা। প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল আর্থিক সহায়তার কারণে পৈত্রিক ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। নোনায় তেতে গেছে ভূমি। মারা গেছে গাছ পালা। পর্যাপ্ত বনায়নের অভাবে অনেকটা মরুভূমির আকার ধারণ করেছে এসব এলাকা।
দক্ষিণের জনপদ খুলনার দাকোপে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছিল ২০০৯ সালের ২৫ মে। ইতিমধ্যে কেটে গেছে নয়টি বছর। আইলার সেই ক্ষত এখনও এ অঞ্চলের মানুষ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। অনেকেই দুর্যোগে ভিটেমাটি ফসলি জমি হারিয়ে এলাকার বাইরে বসবাস করছেন। অনেকে এলাকার কাজ না থাকায় বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ জেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় জীবিকার সন্ধানে বাড়ি ছেড়েছেন। সঙ্কট রয়েছে মিঠাপানির, স্যানিটেশন অবস্থাও ভাল না।
লেখাপড়া চালিয়ে যেতে এলাকার তরুণ-তরুণীরা শহরে থাকছেন। তাদের লেখাপড়ার খরচ চালানো এবং বাড়িতে বসবাসরত পিতামাতার খরচ চালাতে তারা প্রাইভেট পড়ান বলে পরিবারের সাথে আলাপকালে জানা গেছে।
দাকোপের নলিয়ান, গুনারী, কালাবগীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের জনবসতি গত নয় বছরে কয়েক দফা ভাঙ্গনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখনও অনেক পরিবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়ি বাঁধের উপর খুপড়ি ঘর বেঁধে বসবাস করছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই অবস্থাপন্ন গেরস্থ ছিলেন। তাদের ভিটেমাটি হারিয়ে কেউ ভিক্ষা করে কেউ দিনমজুরী, কেউ বা নদীতে মাছ কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বয়োবৃদ্ধ আশরাফ আলী (৮২) বলেন, আর লিখতে হবে না। ২৫ বিঘা জমির সবটুকুই হারিয়েছি। গত নয় বছরে ৫ বার ঘর ভেঙ্গে জায়গা বদল করতে হয়েছে। জানি না এটাও আবার কবে পরিবর্তন করতে হয়। তিনি বলেন, আগে কাজ করে সংসার চালাতাম। আর এখন বয়স হয়েছে। রোগব্যাধি লেগেই আছে। তাই ভিক্ষা করে খাই। কিন্তু সবাই তো বিপদে ভিক্ষা দেয়ার মত লোকও নেই। এখানে এখনও পড়ে আছেন কেন এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, যাব কোথায় নিজের গ্রাম ছেড়ে। বাঁধের উপর থাকলেও নিজের গ্রাম তো!
দাকোপ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তর সূত্রে জানা যায়, আইলার পর এই উপজেলার ১০ হাজার ৬০০ পরিবারকে বিশ হাজার টাকা করে মোট ২১ কোটি ২০ লাখ টাকা বিতরণ। কাবিখার কাজ বরাদ্দ ২৪৫ মেট্রিক টন চাউল বিতরণ। দুটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। এখন বিশেষ কোন বরাদ্দ নেই। সাধারণ বরাদ্দ দিয়েই গ্রামীণ সড়ক, কারভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দুটি ইউনিয়নে ৯টি সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে। ১৫ কিমি ছোট রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ৪টি স্কুলভবন নির্মান করা হয়েছে। দুটি খাল খনন ৪ কিমি। ৫ কিমি ডাবল ইটের সোলিং (রাস্তা) নির্মাণ করা হয়েছে। সম্প্রতি কালিনগর এলাকায় ৩০১ মিটার দৈঘ্যের একটি ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।
বর্তমানে দাকোপের জালিয়াখালী ও কামারখোলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তা টেকসই বেড়িবাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত ২০০৯ সালের ২৫ মে খুলনার দক্ষিণে দাকোপ ও কয়রাসহ বিস্তৃীর্ণ এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আইলার তাণ্ডবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করেছিল এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি, রক্ষিত সম্পদ। জীবনহানি হয় মহিলা শিশুসহ অনেক মানুষের। আইলায় বিচ্ছিন্ন এ জনপথের শেষ ঠিকানা হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ। আইলার তাণ্ডবের ৯ বছর কেটে গেছে। কিন্তু আজও ভুলতে পারেনি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ।
সরকারি হিসেব মতে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাঁচ উপজেলার ৪৫ ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ। সম্পূর্ণ ও আংশিক মিলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৯ হাজার ১৮২ একর জমির ফসল। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেন প্রায় ৩৮ হাজার পরিবার। সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় দাকোপ ও কয়রা উপজেলা। বর্তমানে কয়রা ও দাকোপ উপজেলার প্রায় ১৫ হাজার মানুষ বিভিন্ন বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছেন।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন