রাজধানীর সব বাস টার্মিনাল, কমলাপুর রেলস্টেশন আর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে এখন শুধু মানুষ আর মানুষ। উপচেপড়া ভিড়। মানুষের এই মিছিলে নানা বয়সী নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী তো বটেই, আছে সদ্যোজাত শিশু থেকে শুরু করে আশি বছর পেরিয়ে আসা বুড়োও।
মিছিল চলছে গ্রামমুখী। কত কত দুর্ভোগ। তবু কারো চোখে-মুখে নেই এর ছাপ। বরং চাপা আনন্দ। কারণ দুর্ভোগের পরই যে মিলবে প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা হওয়ার প্রশান্তি।
by Taboola
Sponsored Links
You May Like
This Woman Reads 100 Books A MonthBlinkist
Play this Game for 1 Minute and see why everyone is addictedDelta Wars
গতকাল বুধবার গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদসহ রাজধানী থেকে বাস ছাড়ার আরও অনেক পয়েন্টে ঘুরে দেখা গেছে, অন্যবারের মতো টিকিট কালোবাজারি নিয়ে হাপিত্যেশ নেই। নেই ছিনতাই কিংবা চাঁদাবাজি। যাত্রীদেরও নেই তেমন কোনো অভিযোগ। ঈদের আগাম টিকিট বিক্রি অনেক আগেই শেষ। তবু যাত্রীদের অনেকেই কাউন্টারে, কাউন্টারে বা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কাছে গিয়ে আবদার করছেন টিকিটের; হাতড়ে ফিরছেন সোনার হরিণ। পুলিশের টহল রয়েছে সার্বক্ষণিক।
গতকাল বুধবার গাবতলী বাস টার্মিনাল পরিদর্শন করেছেন যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আর ডিএমপি পুলিশ কমিশনার গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল পরিদর্শন করেছেন।
গতকাল ছিল সরকারি ছুটি। আজ বুধবার কর্মদিবসের পর ফের ঈদের ছুটি। তাই এ দিনের ছুটি নিয়েই সপরিবারে গ্রামের পথে যাত্রা শুরু করেছেন অনেকে। গতকাল ঢাকার প্রধান তিনটি বাস টার্মিনাল গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদে দেখা গেছে গ্রামমুখী মানুষের প্রচ- ভিড়। এ ভিড় বাড়তে থাকবে আগামীকাল শুক্রবার পর্যন্ত।
বাসচালক মেজবাহুজ্জামান বলেন, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। তবে টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া থেকে অনেক জায়গায় মহাসড়কের অবস্থা ভালো নয়। তাই গাড়ি কিছুটা ধীরে চলাচল করছে। গাবতলী বাস টার্মিনালের সহকারী ব্যবস্থাপক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) জোসন আলী আমাদের সময়কে বলেন, গাবতলী বাস টার্মিনালে এ বছর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে দুটি পুলিশ ও একটি র্যাবের অস্থায়ী ক্যাম্প রয়েছে। পাশাপাশি গাবতলী পুলিশ ফাঁড়িও রয়েছে সতর্কাবস্থানে। এখন পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বাস ছেড়ে যাচ্ছে।
মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বাসগুলো বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা নৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু গতকাল এ চিত্র দেখা যায়নি। এ টার্মিনাল থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলাসহ সিলেটেও যাওয়া যায়। মহাখালী বাস টার্মিনালের সহকারী ব্যবস্থাপক বলেন, ঈদের পুরো চাপ এখনো শুরু হয়নি। আজ বৃহস্পতিবার থেকে মূলত ঈদের চাপ শুরু হবে।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালেও গতকাল টিকিট কালোবাজারি বা যানবাহনের শিডিউল বিপর্যয় সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ ছিল না যাত্রীদের। বাস ভাড়াও স্বাভাবিক রয়েছে বলে জানান একাধিক যাত্রী। ঢাকা-কিশোরগঞ্জের রুটে চলাচলকারী অনন্যা পরিবহনের ড্রাইভার জাকির হোসেন জানান, অন্য ঈদে যাত্রীর চাপ হয়। এই ঈদে তেমন চাপ হয় না। ঢাকা-হবিগঞ্জগামী অনিক সুপার পরিবহনের ড্রাইভার রুহুল আমিন বলেন, রাস্তা ভালো আছে। যানজট নেই। তবে এবার যাত্রীর চাপ নেই।
শ্যামলী পরিবহনের একজন ড্রাইভার জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তেমন কোনো সমস্যা নেই। যাত্রীর চাপ বেশি না। যানজট তুলনামূলকভাবে কম আছে। এ কারণে সময়মতোই বাসগুলো টার্মিনাল ছেড়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভিড় বেড়েছে কমলাপুর রেশস্টেশনে। সড়কপথের তুলনায় রেলপথে দুর্ভোগ কম। তাই বেশিরভাগ মানুষের ভরসা রেলপথ। কমলাপুর স্টেশনে গতকাল ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়। আরও ভয়াবহ দশা বিমানবন্দর স্টেশনের। ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে উঠছেন যাত্রীরা। নিরাপত্তা বাহিনীর বাধা বা লাঠিপেটায়ও তাদের নামানো যায়নি। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করার আনন্দে এরকম ঝুঁকি নিচ্ছে ঘরমুখো মানুষ। তবে সময়মতো ট্রেন ছেড়ে না যাওয়ায় প্রতিবারের মতো ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাধারণ যাত্রীরা।
গতকাল সকালে কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, স্টেশনের প্লাটফরমসহ সর্বত্র মানুষ আর মানুষ। ট্রেন আসা মাত্রই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন তারা। ভিড়ের কারণে গেট দিয়ে ঢুকতে না পেরে অনেকে জানালা দিয়ে ভেতরে যান। আবার একজন আরেকজনকে ধরাধরি করে ভেতরে ঢোকেন। ট্রেনে উঠার এ কাতারে নারী, পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই। কাঁধে ব্যাগ আর কোলে শিশু এটিই ছিল গতকাল স্টেশনের চিত্র। ট্রেনের ভেতর কোনো জায়গা ফাঁকা না পাওয়ায়, ছাদে উঠতে বাধ্য হয়েছেন অনেক যাত্রী।
দীর্ঘ দুর্ভোগ ও প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে রাজধানীবাসী বাড়িতে ছুটছেন, আপনজনের কাছে। গতকাল ছিল সবচেয়ে বেশি মানুষের ঢল। প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করবেন বলেই সবার মধ্যে আনন্দ ও উচ্ছ্বাস বিরাজ করছে। তাই প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও কমলাপুর স্টেশনে ঘরমুখো মানুষের ভিড় দেখা গেছে।
প্রতিবছরের মতো এবারও ট্রেনে যাত্রা বিলম্ব ঘটে। লালমনিরহাটগামী ঈদ স্পেশাল এবং খুলনাগামী সুন্দরবন ট্রেন দুটি নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা পর স্টেশন ছেড়ে যায়। লালমনিরহাটের লালমনি ঈদ স্পেশাল ট্রেন বেলা সোয়া ৯টায় ছেড়ে যাওয়ার কথা। ছাড়ে বেলা ১১টায়। রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন সকাল ৯টায় ছাড়ার কথা থাকলেও তা সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ছেড়েছে। নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনের ছাড়ার সময় সকাল ৮টায়। আধাঘণ্টা দেরি করে সকাল সাড়ে ৮টায় ছেড়ে গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস কমিউটার ট্রেন সকাল সাড়ে ৯টার পরিবর্তে বেলা ৯টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে গেছে। জামালপুরের তারাকান্দি রুটের অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ট্রেন আধাঘণ্টা দেরি করে সকাল সোয়া ৯টায় ছেড়েছে। এ ছাড়া দিনাজপুরের একতা এক্সপ্রেস ২০ মিনিট দেরি করে বেলা ১০টা ২০ মিনিটে ছেড়েছে। ৫৯টি ট্রেন কমলাপুর থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ঢাকা ছাড়ে।
কমলাপুরের স্টেশন ম্যানেজার সীতাংশু চক্রবর্তী জানান, দুয়েকটি ট্রেনে দেরি হলেও একে শিডিউল বিপর্যয় বলা যাবে না। ঈদ উপলক্ষে প্রতিদিন প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ হাজার মানুষ বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছেন।
গতকাল দুপুরে কমলাপুর স্টেশনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে যান রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক। তিনি রাজশাহীগামী সিল্কসিটি ও চট্টগ্রামগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেসের যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন।
পরে মন্ত্রী সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ঈদ উপলক্ষে আমরা সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে যাত্রীদের সেবা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যাত্রীরা যেন নির্বিঘেœ ঈদ পালন করে আবার ঢাকায় ফিরে আসতে পারে তার সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
অন্যদিকে ‘এই যে ছাইড়া গেল....বরিশাল বরিশাল’; ‘ছাইড়া গেল...ভোলা’ কিংবা ছাইড়া গেল চাঁদপুর’; ‘আগে গেলে, আগে আসেন’Ñ লঞ্চের কলারম্যানদের এমন ডাকে গতকাল মুখরিত ছিল সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল। গতকাল সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় বাড়িফেরা মানুষের স্রোত নামে সদরঘাটে। ভোর থেকে গভীর রাত অবদি ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়। সড়কের তীব্র যানজট আর টার্মিনালে দুর্ভোগ উপেক্ষা করে উৎসবপ্রেমী বাঙালির ঈদযাত্রার চিরচেনা দৃশ্য এই ঘাটে। বৃদ্ধ, তরুণ, নারী-শিশু সব বয়সীর ঈদযাত্রায় যেন আনন্দের ছাপ তাদের চোখে-মুখে। হাতে, কাঁধে, পিঠে ব্যাগ চড়িয়ে ভিড় ঠেলে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে উঠতে হচ্ছে কাক্সিক্ষত লঞ্চে। বিখ্যাত মোটিভেটর শিব খেরার ‘মানুষ জন্মসূত্রে বিজয়ী’ উক্তির যথাযথ দেখা মেলে এই প্রতিযোগিতায়। তিল ধারণের ঠাঁই নেই টার্মিনালে। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে বাবার হাত ধরা সন্তান, স্বামীর হাতে স্ত্রী, ভাইয়ের হাতে বোন সতর্ক সবাই।
উত্তরা থেকে সদরঘাট পৌঁছতে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লেগেছে জানিয়ে গ্রামমুখী তামান্না ইসলাম হাসিমুখে বলেন, ঈদ বাড়িতে উদযাপন করব, এতটুকু কষ্ট তো করতেই হয়। রোজা রেখে কষ্ট হচ্ছে। এখন লঞ্চে চড়তে পারলে সব কষ্ট সার্থক।
শিবচরের উদ্দেশে যাওয়ার জন্য এসে লঞ্চ টার্মিনালে না দেখে বিরক্ত মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, লঞ্চ আগেই ছেড়ে গেছে। এখন আরেকটা আসবে, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে টার্মিনালে। স্ত্রী সন্তানসহ ব্যাগ নিয়ে এখানে অপেক্ষা করা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছি।
ঢাকা-চরভৈরবী রুটে যাতায়াতকারী মেঘনা রানী লঞ্চ থেকে নেমে এসে একাধিক যাত্রী অভিযোগ করেন, এই লঞ্চের কেবিনগুলো যেন কবুতরের বাক্স। নিরাপদ যাতায়াত অযোগ্য এ ধরনের জাহাজ কীভাবে সরকার অনুমোদন দেয়?
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্যানুযায়ী দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত ৪১টি রুটে লঞ্চ যাতায়াত করছে। নিয়মিত যেখানে প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০টি লঞ্চ চলাচল করত। এখন ঈদে অতিরিক্ত সার্ভিস দিচ্ছে সব রুটে। ফলে এর সংখ্যা ১৫০ বেশি হবে।
লঞ্চ টার্মিনাল হকারমুক্ত করার কাজে অবহেলার জন্য টার্মিনালের পুলিশ, আনসার ও সংশ্লিষ্টদের অভিযুক্ত করেছিলেন নৌ-পরিবহনমন্ত্রী মো. শাজাহান খান। গত ৪ মার্চ ঢাকা সদরঘাটে নিরাপদ ও দুর্ঘটনামুক্ত নৌযান চলাচল নিশ্চিত করার ঈদপূর্ব এক প্রস্তুতি সভায় মন্ত্রী তাদের প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর পরও থেমে নেই যাত্রী হয়রানি, ঘাট শ্রমিকদের উৎপাতে অতিষ্ঠ যাত্রীরা।
ঢাকা নদীবন্দর নৌযান পরিদর্শক দীনেশ কুমার সাহা জানান, এবার আবহাওয়ার বিষয়টি খুব গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যেন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে দ্রুত নৌ হুশিয়ারি সংকেত উঠানো যায়।
সরকারি নিয়মানুযায়ী ঈদুল ফিতরের তিন দিনের ছুটি থাকে। আজ ২৮ রোজা ঈদের আগের কার্যদিবস। আগামীকাল থেকে ঈদের ছুটি। বর্ষপঞ্জী হিসেবে শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটি রয়েছে। শুক্রবার চাঁদ দেখা গেলে শনিবার ঈদ। ৩০ রোজা হলে পরদিন রবিবার ঈদুল ফিতর।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন