ঈদে নাড়ীর টানে ছুটছে মানুষ। যে যেভাবে পারছেন, যাচ্ছেন। উদ্দেশ্য একটিই— ঝক্কি-ঝামেলা সয়ে হলেও স্বজনদের সঙ্গে ঈদের খুশি ভাগাভাগি করা। সড়ক ও নৌপথে ইতোমধ্যে মানুষের স্রোত নেমেছে। ফলে সড়কে দীর্ঘ যানবাহনের সারি, চলছে থেমে থেমে। পথে পথেই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের।
যারা একটু স্বস্তির ঈদযাত্রার আশায় আকাশপথ বেছে নিয়েছিলেন, তারাও পড়েছেন চরম বিপাকে। বিমানসংস্থাগুলো যাত্রীর চাপে হোক আর মুনাফার আশায়, অসংখ্য টিকিট বিক্রি করেছেন। কিন্তু, নির্ধারিত দিনে এসে অনেকেই সঠিক সময়ে ফ্লাইট পাচ্ছেন না। বিমানবন্দরেই দীর্ঘ সময় কাটাতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটগুলোর চরম সিডিউল বিপর্যয় নেমে এসেছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন আকাশ পথে ঈদে ঘরমুখো হাজার হাজার যাত্রী।
অভিযোগ উঠেছে, অধিক মুনাফার আশায় প্রয়োজনের তুলনায় কম উড়োজাহাজ নিয়ে অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনা করতে গিয়ে যাত্রীদের এই ভোগান্তিতে ফেলেছেন অভ্যন্তরীণ রুটের এয়ারলাইন্সগুলো।
রাজশাহীগামী বেসরকারি ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের যাত্রী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাসানাত আলী পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘আমার রাজশাহীতে ইউএস-বাংলার ফ্লাইট ছিল বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে তিনটায়। কিন্তু, বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত সেই ফ্লাইট ছাড়েনি। কি কারণে দেরি হচ্ছে, সেটাও জানতে পারিনি। শুধু আমাদের ফ্লাইট না, সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন রুটের ফ্লাইটও দেরি হচ্ছে বলে জেনেছি।’
নিয়মিত আকাশপথ ব্যবহারকারি এই শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বিমানের সিডিউল বিপর্যয় নতুন কিছু নয়। এটা আন্তর্জাতিকভাবেও হয়। কিন্তু, যারা এসব ফ্লাইট পরিচালনা করছেন, তারা আমাদের (যাত্রীদের) কোনো খোঁজও নিচ্ছেন না। তারা এসে ন্যূনতম দুঃখও প্রকাশ করছেন না।’
রাশেদ আহমেদ নামে একজন ব্যবসায়ী যাবেন সৈয়দপুরে। তিনি পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘আমি ইউএস-বাংলার বিকেল চারটা ১০ মিনিটের ফ্লাইটের যাত্রী। কিন্তু, সন্ধ্যা ছয়টা ১০ মিনিটেও আমাদের ফ্লাইট ছাড়েনি।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘ঈদে পরিবারের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে আমরা গ্রামে যাই। ঈদকে ঘিরে সড়কে দীর্ঘ যানজট। সেখান থেকে মুক্তি পেতে ঘরমুখো মানুষ আকাশ পথকে বেচে নেন। আর আমাদের এই প্রয়োজনকে পুঁজি করে এয়ারলাইন্সগুলো এসব অসভ্য আচরণ করছে।’
রাশেদ আহমেদ আরও বলেন, ‘সক্ষমতার তুলনায় অধিক ফ্লাইট পরিচালন করতে গিয়ে আমাদের ভোগান্তিতে ফেলছেন বিমানসংস্থাগুলো। তারা স্বল্প সংখ্যক উড়োজাহাজ নিয়ে অধিক সংখ্যক ফ্লাইট পরিচালনা করছেন।’
তিনি এসব বিষয় খতিয়ে দেখার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ রুটে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, বেসরকারি ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, নভোএয়ার ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে। অভ্যন্তরীণ ৭টি রুট— সৈয়দপুর, রাজশাহী, যশোর, বরিশাল, সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে এই বিমানসংস্থাগুলো তাদের ফ্লাইট পরিচালনা করে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স গত ২৫ মার্চ থেকে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে সপ্তাহে ১০টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে সপ্তাহে ৩২টি, ঢাকা-যশোর রুটে ৮টি, ঢাকা-বরিশাল রুটে ৩টি, ঢাকা-সিলেট রুটে ৩৪টি, ঢাকা-রাজশাহী রুটে ৪টি এবং ঢাকা-সৈয়দপুরে সপ্তাহে ৭টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স বর্তমানে ঢাকা থেকে সৈয়দপুর রুটে দৈনিক দুটি, যশোরে দুটি, রাজশাহীতে একটি ও বরিশালে সপ্তাহে চারটি ফ্লাইট পরিচালনা করে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম রুটে দৈনিক পাঁচটি, কক্সবাজারে দুটি ও সিলেটে একটি ফ্লাইট পরিচালনা করে তারা।
তাদের সকল টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে উল্লেখ করে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘সৈয়দপুর, রাজশাহী, বরিশাল ও যশোরের সব টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। এখন অতিরিক্ত ৩৫টি ফ্লাইট এই চারটি রুটে পরিচালনা করব।’
রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ঢাকা-কক্সবাজার রুটে সপ্তাহে সাতটি, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ২৮টি, ঢাকা-যশোর রুটে ১৪টি ও ঢাকা- সৈয়দপুর রুটে সপ্তাহে ১৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
রিজেন্টের এক কর্মকর্তা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘আমাদের জুনের ১০ তারিখ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ টিকেট বিক্রি শেষ। একটা অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে কক্সবাজার রুটে।’
নভোএয়ার বর্তমানে ঢাকা থেকে সৈয়দপুর রুটে দৈনিক চারটি, যশোরে তিনটি ও রাজশাহীতে একটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। আর চট্টগ্রাম রুটে দৈনিক ছয়টি ও কক্সবাজারে চারটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে তারা।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ রুটে এবার প্রচুর যাত্রীর চাপ। এজন্য সক্ষমতার চেয়ে বেশি ফ্লাইটের টিকিট বিক্রি করা হয়েছে। নির্ধারিত দিনে এয়ারক্রাফটগুলো পালা করে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, সৈয়দপুর, যশোরসহ বিভিন্ন রুটে যাত্রী নিচ্ছেন। ফলে সময় একটু বেশি লাগছে।’
শাহজালাল বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) কর্মকর্তা ওহিদুর রহমান পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘রানওয়েতে কোনো সমস্যা নেই। আমরা যেকোনো ফ্লাইট আসলেই ক্লিয়ারেন্স দিচ্ছি। এখন ফ্লাইটের সিডিউল বিপর্যয় হয়ে থাকলে সেটা এয়ারলাইন্সগুলোর কোনো সমস্যার জন্য হয়ে থাকতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘এমনও হতে পারে— এয়ারলাইন্সগুলো তাদের উড়োজাহাজের সংখ্যার তুলনায় বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করছেন। ফলে সিডিউল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।’
শাহজালাল বিমানবন্দরের সহকারী পরিচালক মোশাররফ হোসেন পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘বিমানবন্দরের রানওয়ের সব ক্লিয়ার আছে। আমার জানা মতে, কোনো সমস্যা নেই।’
ফ্লাইট বিপর্যয়ের অভিযোগ অস্বীকার করে বিমান বাংলাদেশের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) শাকিল মিরাজ পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘বিমান বাংলাদেশের সব ফ্লাইট সঠিক সময়ে যাচ্ছে। কোনো সিডিউল বিপর্যয় নেই।’
সিডিউল বিপর্যয়ের বিষয়ে ইউএস-বাংলার প্রধান নির্বাহী ইমরান আসিফের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন