তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর থেকেই দেশের রাজনীতিতে নানাভাবে আলোচিত হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রসঙ্গ। সম্প্রতি এ আলোচনা নতুন প্রেক্ষাপটে বেশ জোরালোভাবে শুরু হয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে অক্টোবরে মন্ত্রিসভার আকার ছোট করতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। ৩০ জনকে নিয়ে এ মন্ত্রিসভা গঠিত হবে বলে ১৪ দল সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দিতে পারে বিএনপি। এ নিয়ে রাজনীতির অন্দরমহলে চলছে নানামুখী আলোচনা। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি বিষয়টি অস্বীকার করলেও ২০ দলীয় জোটের শরিক এলডিপি খোলাখুলিই বলেছে, দলের সভাপতি অলি আহমদ নির্বাচনকালীন সরকারের উপদেষ্টা বা মন্ত্রী হচ্ছেন। এ নিয়ে এখন আলাপ-আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে সরকারের তরফ থেকে বিএনপির দুই জ্যেষ্ঠ নেতা মির্জা ফখরুল ও খন্দকার মোশাররফের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে বলে রাজনীতির অন্দরমহলে আলোচনা উঠেছে। যদিও এই দুই নেতা এ নিয়ে কথা বলতে চাননি। তবে অপর এক নেতা এটাকে গুঞ্জন বলেই উড়িয়ে দিয়েছেন।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার অবশ্যই একটি নিরপেক্ষ সরকার হতে হবে। এই সরকারের রূপ কেমন হবে তা অবশ্যই জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে। কোনো একটি দলের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।’
২০ দলীয় জোটের শরিক দল এলডিপি অবশ্য স্বীকার করছে, সরকারের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের কথা। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম জানান, দশম সংসদ নির্বাচনের মতো আর ভুল করবে না এলডিপি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, প্রাথমিকভাবে বর্তমানে যারা পার্লামেন্টে আছেন তাদের কাছ থেকেই বাছাই করা হবে। কিন্তু সরকারপ্রধান যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য পার্লামেন্টের বাইরে থেকে কাউকে নিতে চান, সেটা তিনি বিবেচনা করতেই পারেন। সংবিধান অনুযায়ী, টেকনোক্র্যাট কোটায় এক-দশমাংশ মন্ত্রী রাখার বিধান আছে।
এদিকে অনেক দিন থেকেই সরকারের বাইরে থাকা অধিকাংশ দল বলে আসছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। বিরোধী দলসমূহের এমন দাবির প্রেক্ষিতে বিগত সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রধামমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। একইসঙ্গে তাদের পছন্দমতো মন্ত্রণালয় বেছে নেয়ার সুযোগও দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই সময় বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক দফা দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে এবং সরকারে যোগ না দিয়ে নির্বাচন প্রতিহতের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এরপর কেটে গেছে প্রায় ৫টি বছর। ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসছে নির্বাচনের দিনক্ষণ। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেবেন কিনা বা দিলেও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি কিভাবে সরকারের অংশীদার হবে সেসব বিষয় এখনো পরিষ্কার নয়। তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী নেয়া যাবে ১০ শতাংশ। অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সরকার যদি ৩০ সদস্য বিশিষ্ট হয় তবে সংসদের বাইরে থাকা দলগুলো থেকে নেয়া যাবে ৩ জন।
একইসঙ্গে তারা বলেন, বর্তমান সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো বিধান নেই। অর্থাৎ কোনো ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ দায়িত্ব এ সরকারকে পালন করতে হবে না। ম্যান্ডেটকালীন সময়ের দায়িত্ব পালনের কারণে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগের ইচ্ছা ব্যক্ত করারও কোনো প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রয়োগ করছেন নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবেও তিনি একই ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। অন্যদিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকেও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সব কাজ করতে হবে। সরকার চাইলে অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন করতে পারবে। যদিও সরকারের পক্ষে বলা হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকার শুধুমাত্র রুটিন কার্যাবলী পরিচালনা করবে। নীতি নির্ধারণী কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে না। একটি অবাধ সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকার নির্বাচন কমিশনকে সার্বিক সহযোগিতা দেবে।
নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে সংবিধানের ১২৩-এর ৩ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে। মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’
সংবিধানে সংসদ বহাল থাকলে সংসদের মেয়াদ শেষের পূর্বের ৯০ দিন সময়কে এবং সংসদ বিলুপ্ত বা ভেঙে গেলে পরবর্তী ৯০ দিন সময়কে নির্বাচনকালীন সরকার বলে অভিহিত করা হয়েছে। আসছে জানুয়ারি মাসে যেহেতু সরকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে এবং ক্ষমতাসীনরা যেহেতু সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করতে চায় সেকারণে অক্টোবরে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কথা বলা হচ্ছে।
১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের সাধারণ নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে সব ধরনের নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিচালনা করেছেন ক্ষমতাসীন সরকার।
১৯৯১ সালে সর্বপ্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের কারণে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রয়োজন দেখা দেয়। ২০১৩ সালের ১৮ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী নির্বাচনকালীন ‘সর্বদলীয়’ মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব দেন। সংবিধান অনুযায়ী ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনকালীন সরকারের সময় শুরু হয়। নবম সংসদের ১৯তম অধিবেশনের শেষ কার্যদিবসে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি তাকে অনুমতি প্রদান করেছেন। নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালনের জন্য ২০১৩ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হয়। দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব বিএনপি প্রত্যাখ্যান করে। নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় বিরোধী দল ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং জাতীয় পার্টির সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির ফলে এ সরকার সর্বদলীয় সরকারে রূপ নেয় বলে দাবি করা হয়। ২৮ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় ২১ জন মন্ত্রী এবং ৭ জন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। আওয়ামী লীগের ছিলেন ১৫ জন মন্ত্রী এবং ৫ জন প্রতিমন্ত্রী। জাতীয় পার্টির ৪ জন মন্ত্রী, মন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন একজন উপদেষ্টা ও দু’জন প্রতিমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান পান। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে এবং সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়–য়াসহ ১০ উপদেষ্টা ঠাঁই পান।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আগামী অক্টোবরে এ ধরনের একটি সরকার গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ২০ জুন সচিবালয়ে এক পর্যালোচনা সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণার পর নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হবে। অক্টোবর মাসে সম্ভাবনা বেশি। নির্বাচনী সরকারের পরিসর ছোট হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। তখন মন্ত্রিসভা ছোট হবে, তখন ঢাউস মন্ত্রিসভার প্রয়োজন নেই। মেজর কোনো পলিসি বা ডিসিশন নিতে পারবে না, সেই সরকার শুধু রুটিন ওয়ার্ক করবে।’
‘নির্বাচনকালীন সরকার’ বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের এই অবস্থান সম্পর্কে যুক্তফ্রন্টের সদস্য সচিব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না মানবকণ্ঠকে বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমরা চাই একটি দলনিরপেক্ষ সরকার। সব দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এর রূপরেখা তৈরি করতে হবে। আবারো যদি ৫ জানুয়ারির আগের মতো একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয় তবে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য হবে না। এর মাধ্যমে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো আরেকটি একতরফা নির্বাচন হবে।
তিনি বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে নির্বাচনের ১শ’ দিন আগে অবশ্যই সংসদ ভেঙে দিতে হবে। অন্যদিকে যেহেতু বর্তমান নির্বাচন কমিশন তাদের গ্রহণযোগ্যতা সম্পূর্ণরূপে হারিয়েছে সে কারণে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন ১৪ দলের অন্যতম নেতা, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, আমাদের দেশে যখন নির্বাচন আসে তখন দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে দেশীয় প্রক্রিয়া যেমন থাকে তেমনি বিদেশিরা যুক্ত হয়। এবারো আমরা লক্ষ্য করছি যে, বেশ কিছুদিন ধরে দেশে একটি রাজনৈতিক অসন্তোষ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। স্বাভাবিকভাবেই সরকার পরিচালনা যারা করছেন তাদের একটি দায়-দায়িত্ব রয়েছে নির্বাচনের পরিবেশকে স্বাভাবিক রাখা।
তিনি আরো বলেন, কিন্তু যদি বার বার এই প্রচেষ্টাগুলো চালানো হয়, বার বার যদি নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা আসে তাহলে এ ব্যাপারে কোনো না কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হয়। কে ক্ষমতায় যাবে না যাবে সেটা নির্ধারণ করবে জনগণ। সুতরাং কেউ যদি জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করে সেখানে প্রতিরোধ করা ছাড়া কোনো উপায়ান্ত থাকবে না। তাই আমি আশা করব বিএনপি বর্তমান বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। যেহেতু তারা বলছেন তারা সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। নির্বাচনের মাধ্যমে তারা এটা প্রমাণ করুক। আমরা জনগণের রায়কে মাথা পেতে মেনে নেব।
মানবকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন