বেইজিংয়ে (১৪-১৫ মে) অনুষ্ঠিত ‘ওয়ান বেল্ট এন্ড ওয়ান রোড’ (ওবিওআর) বা ‘বেল্ট এন্ড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ভারত যোগ দেয়নি। এই যোগদান না করার পেছনে দিল্লির দাবি মতো শুধু সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন ছিলো না। ভারতের দাবি করা পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে ‘চীন-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর’ (সিপিইসি) অতিক্রম করাও এর মূল কারণ নয়। একজন ভারতীয় ভাষ্যকারের বক্তব্যে আসল কারণটি বেরিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, ওবিওআর সম্মেলন এড়িয়ে যাওয়া আসলে একটি কৌশলগত দাবি।
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অংশকে সংযুক্ত করে যে মেগা কানেকটিভিটি উদ্যোগ এগিয়ে চলেছে, বিশেষ করে সিপিইসি’র ব্যাপারে এই দাবি জানানো হয়। এটা মূলত এসেছে কথিত ‘মুক্তার মালা’ – মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের বন্দরগুলো – দিয়ে ভারতকে ঘিরে ফেলা হচ্ছে বলে ভারতের যে কৌশলগত মানসিকতা রয়েছে সেখান থেকে। সম্প্রতি কলকাতায় আয়োজিত এক সেমিনারে ভারতীয় নৌবাহিনীর সাবেক উপপ্রধান পি কে চ্যাটার্টি বলেন যে চীন আসলে ভারতকে ঘিরে ফেলতে চাচ্ছে না, কিন্তু তার বিশাল অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য দেশটির জলপথে প্রবেশে জন্য স্থলপথের প্রয়োজন। কারণ, তার পূর্ব উপকূলের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। চ্যাটার্জি বলেন, এসব দেশের মধ্য দিয়ে স্থল-জল পথের সংযোগ চীনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং এসব পথের জন্য যেকোন হুমকির ব্যাপারে মনোব্যাধির মতো। চীনের অভিসন্ধি অনুধাবন এবং তার ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ বোঝার জন্য এটি একটি বিচক্ষণ উপায়।
ভারত ও ভুটান বাদে দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশেই বর্তমান ওবিওআর-এর আওতায় রয়েছে। এই উদ্যোগ এমন কিছু দেশে চীনের কৌশলগত প্রভাব জোরদার করেছে যেখানে ভারতেরও বিপুল স্বার্থ রয়েছে। ভারতের স্বার্থের মধ্যে বিগত তিন বছরে নেয়া কানেকটিভিটি উদ্যোগ ও অবকাঠামো প্রকল্পগুলো রয়েছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে অনুপ্রবেশ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দিল্লিকে আস্থায় নেয়া ছাড়াই বেইজিং একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমানে এসব প্রকল্প যে অবস্থায় চলছে তা দেশগুলোকে আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে ঠেলে দেবে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে দিল্লির ওপর। শুধু তাই নয়, সংঘাতের সময় দিল্লির জন্য এগুলো কৌশলগত সমস্যাও তৈরি করবে। কিন্তু, ভারত যখন ভিয়েতনামের সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগরে তেল অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তখন কি সে বেইজিংকে আস্থায় নিয়েছিলো? ওবিওআর এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে চীন প্রাথমিকভাবে তাদের স্বার্থই দেখবে, এটা বাস্তব কথা। তার কাছ থেকে অন্যকিছু আশা করা শিশুসুলভ হবে। কিন্তু, অন্য দেশগুলো, বিশেষ করে ভারতের প্রতিবেশি দেশগুলোর উচিত হবে এসব উদ্যোগ থেকে তারা কতটুকু লাভবান হতে পারবে তা ভালোভাবে খতিয়ে দেখা।
এই অঞ্চলজুড়ে ভারত দ্বিপাক্ষিক এবং বিবিআইএন ও বিমসটেকের মতো উপ-আঞ্চলিক বেশ কিছু কানেকটিভিটি উদ্যোগ নিয়েছে। মোদি সরকারের ‘এ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’র আওতায় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ প্রতিষ্ঠায় এসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি, ইরানের চাবাহার বন্দর ও ‘ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্টেশন করিডোর’ রাশিয়া, মধ্য এশিয়া, ইরান, আফগানিস্তান ও ইউরোপে ভারতের উপস্থিতি জোরদার করবে।
তাই ভারতের বিরোধিতা শুধু সিপিইসি’র মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সে ওবিওআর’র বিশালত্ব নিয়ে, বিশেষ করে তা যেভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তৃত হচ্ছে, তাতে বিচলিত হয়ে পড়েছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র গোপাল বাগলে সম্প্রতি বলেছেন যে ভারত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে কানেকটিভিটি উদ্যোগগুলো সার্বজনিনভাবে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, সুশাসন, আইনের শাসন, উন্মুক্ততা, স্বচ্ছতা ও সমতার ভিত্তিতে হতে হবে।
কিন্তু চীন যুক্তি দেখায় যে ওবিওআর সম্মেলন আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো এই মেগা কানেকটিভিটি প্রকল্পের প্রভাব ফেলবে এমন সকল দেশকে আস্থায় নেয়া এবং এই ইস্যুতে তাদেরকে মতামত প্রকাশের একটি সুযোগ করে দেয়া। কলকাতায় নিযুক্ত চীনের কনসাল মা চানউ এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, যেসব দেশের মধ্য দিয়ে ওবিওআর অগ্রসর হবে সেগুলোর একটি সম-সুফল লাভের [উইন-উইন] পরিস্থিতি তৈরি করবে এবং এটা স্নায়ুযুদ্ধের যুগের মতো কোন ভূ-রাজনৈতিক রণকৌশল নয়।
তাই, বিআরআই ফোরামের সম্মেলনে না গিয়ে কোন রাখঢাক না করেই ভারত স্পষ্ট করে দিয়েছে যে ওবিওআর/বিআরআই নিয়ে সে অসন্তুষ্ট। কিন্তু, সম্মেলনে যারা যোগ দিয়েছেন তাদের সামনে নিজের আপত্তিগুলো তুলে ধরার সুযোগ সে হারিয়েছে। এই প্রকল্প উপেক্ষা করার কোন সুযোগ ভারতের সামনে নেই। সে যদি বাস্তবতার নিরিখে চীনের সঙ্গে মোকাবেলা করতে চায় তাহলে তার কূটনীতিক ও অর্থনীতিবিদের এ নিয়ে আরো অনেক বেশি গবেষণা ও ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। চীন ওবিওআর নিয়ে এগিয়ে যাবে, ভারতের আপত্তিতে আটকে থাকবে না এ কথা মনে রাখতে হবে।
ভারতের শীর্ষস্থানীয় চীন বিশেষজ্ঞ জাবিন জ্যাকব সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় আমাকে বলেছেন যে চীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক পদ্ধতির মতো অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাগুলো বিদেশে টানাপড়েনের পরীক্ষায় কতটা উত্তীর্ণ হয় তা দেখার একটি বড় সুযোগ তৈরি করেছে এই ওবিওআর। ‘হ্যাঁ, এই প্রকল্পের হয়তো খুব বেশি অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা নেই। কিন্তু কথায় যেমন বলে -‘কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে’, তেমনিভাবে পরাশক্তি হওয়ার জন্য এটা চীনকে শেখার অনেকগুলো পথ তৈরি করে দিয়েছে। সামনে শেখার যে সুযোগ তৈরি হচ্ছে তা থেকে দূরে সরে থাকা ভারতীয়দের জন্য উচিত হবে না।
চীন যেভাবে ওবিওআর এগিয়ে নিচ্ছে তা থেকে ভারতের অনেক কিছু শেখার আছে – এ বিষয়ে আমিও জ্যাকবের সঙ্গে একমত। ছোট আকারের হলেও ভারতের একই ধরনের উদ্যোগ রয়েছে। যেখানে ওবিওআর প্রকল্পগুলো সফল হবে সেখান থেকে কিভাবে সুফল হাসিল করা যায় ভারতকে তা নিয়ে ভাবতে হবে। এই সুফল হাসিল শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই হবে না। এক কথায়, দিল্লি যদি ওবিওআর-এর প্রতি চোখ বন্ধ রেখে শুধু নিজের উদ্যোগগুলো নিয়েই এগিয়ে যায় তাহলে বড় ধরনের ভুল করবে। চীনাদের সফলতার আরেকটি মানে হলো বকেয়া বা অপরিশোধিত ঋণের বিনিময়ে মালিকানা লাভ। এ নিয়ে ওইসব দেশে এই ভেবে অন্তর্জালা তৈরি হয় যে তারা চীনের কলোনিতে পরিণত হচ্ছে।
পাকিস্তানসহ ওবিওআর দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের আলাদা লাইন রক্ষা করা উচিত ভারতের। দিল্লিকে বয়কটের মুড থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যেসব দেশ চীনের সঙ্গে ওবিওআর-এর অংশ নিয়েছে সেগুলোর সঙ্গে কোন লেনদেন করবে না – এমন কথা বলার সুযোগ ভারতের নেই। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে বিষয়টি কঠিনভাবে শিখেছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান। উপেক্ষা করার কৌশলে কাজ হবে না। তাদের ঘনিষ্ঠতম মিত্ররাও এআইআইবি’তে যোগ দিয়েছে। আর তাই যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান দু’দেশই ওবিওআর সম্মেলনে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়। আর, ভারতের দূরে থাকার সিদ্ধান্ত একরকম ‘একঘরে হয়ে পড়া’ বলে মনে হয়।
উত্তর কোরিয়াকে সামাল দিতে ট্রাম্পের চীনকে প্রয়োজন। গ্লোবকপ [বিশ্বপুশিল]-এর ভূমিকা নিতে ট্রাম্পের অনিচ্ছা জাপানকে বাধ্য করেছে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উপায় খুঁজে বের করতে। ট্রাম্পের এইচ১বি ভিসা ভারতকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ভারতের আইটি শিল্পের ওপর তা গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কাশ্মির বিরোধে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার ব্যাপারে ট্রাম্পের উদ্যোগ ভারতকে মর্মাহত করেছে। অন্যদিকে, চীন বলেছে সে চায় যেন ভারত পাকিস্তানের বিরোধগুলো দ্বিপাক্ষিকভাবে মিমাংসা করা হয়। তবে, দু’পক্ষ রাজি হলে সে মধ্যস্থতা করতে পারে। চীনের এই বক্তব্য অনেক বেশি নমনীয় মনে হয়।
বর্তমান জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় ভারত ও চীনকে খুঁজে বের করতে হবে। তবে এই মুহূর্তে গুরু দায়িত্বটি চীনের। তারাও এটা জানে এবং সে কারণেই ভারতকে ওবিওআর/বিআরই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার জন্য ব্যাপকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চীনা বিনিয়োগ হারিয়ে ভারত চলতে পারবে কিনা শেষ পর্যন্ত সে তা ভাবতে বাধ্য হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ভারত সরকারের ফ্লাগশিপ ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এন্ড ‘সিল্ক ইন্ডিয়া’ প্রচারণার সফলতার জন্য এই বিনিয়োগ জরুরি। ভারতের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে এসব ফ্লাগশিপ প্রাচারণা সফল করতে অন্য যে কোন দেশের চেয়ে মাত্রা, অভিজ্ঞতা ও অর্থের জন্য চীন অনেক ভালো জায়গায় – এ ব্যাপারে জাবিন জ্যাকবের সঙ্গে আমি একমত।
কিন্তু এ জন্য শুধু ওবিওআর নিয়ে গুটিকতক চুক্তি করলেই হবে না, ওই প্রচেষ্টা সফল করতে হলে দুই দেশের মধ্যে আইনগত ও কারিগরিক্ষেত্রে বিস্তারিত চুক্তি থাকতে হবে। চীনের প্রস্তাব মতো দ্রুত সম্ভব সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলা ভারতের উচিত হবে। বেইজিংয়ের প্রস্তাব মতো ‘সেক্টর-বাই-সেক্টর’ চুক্তি করা যায় কিনা দিল্লিকে তা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। পরিশেষে বলতে হয়, ভারতের প্রয়োজন চীনা বিনিয়োগের, আর চীনের প্রয়োজন ভারতীয় বাজার – কঠিন বাস্তবতা এটাই।
সুবীর ভৌমিক, খ্যাতনামা সাংবাদিক ও বিবিসি’র সাবেক সংবাদদাতা, কলামটি সাউথএশিয়ানমনিটর.কম–এর জন্য লেখা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন