কাতারের স্যাটেলাইট চ্যানেল আল জাজিরা বন্ধের জন্য সৌদি আরব ও ইসরাইল দাবি তুলেছে। তাদের এই দাবির প্রেক্ষিতে বলা যায় চ্যানেলটি অবশ্যই সঠিক কিছু করছে। সর্বোপরি সৌদি কর্তাদের এবং দখলদার ইসরাইলিদের মধ্য মিত্রতা একটা প্রাপ্তিই বলতে হবে।
কিন্তু এই সম্পর্কে খুব রোমান্টিক হবেন না। যখন বিত্তশালী সৌদিরা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তারা জানেন যে, চিকিৎসার জন্য তাদের ইসরাইলের সেরা হাসপাতালগুলোতে নিজেদের ব্যক্তিগত বিমানে করে তেল আবিবে উড়ে যেতে হবে।
আর যখন সৌদি আর ইসরাইলি যুদ্ধ-বিমানগুলো বোমা বহন করে আকাশে উড়ে, তখন আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে, তারা সিরিয়া কিংবা ইয়েমেনের শিয়াদের ওপর বোমা হামলা চালানোর জন্য যাচ্ছে।
এবং যখন সৌদি আরবের বাদশা সালমান কিংবা প্রিন্স মোহাম্মদ উপসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হিসাবে ইরানের দিকে ইঙ্গিত করে, তখন আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন যে, বিবি নেতানিয়াহু ঠিক কি করতে থাকবেন এবং একইভাবে ‘উপসাগরীয় নিরাপত্তা’কে প্রতিস্থাপন করলে অবশ্যই সেটি হবে ‘ইসরাইলের নিরাপত্তা’।
কিন্তু এটি একটি অদ্ভুত ব্যবসা। সৌদি আরব কেবল স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বাতিঘর দ্বারা সমর্থিত হয়ে মিডিয়ার গতিকে দমন করে থাকে। যেটি ইসরাইলি গান এবং কিংবদন্তিতে পাওয়া যায়।
সুতরাং আমরা দেখে নিতে পারি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি সাম্প্রতিককালে ইসরাইলি সহনশীলতার প্রদর্শন! যেটিকে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হিসেবে আমরা সবাই সমর্থণ করি, প্রতিপালন করি, ভালোবাসি এবং সম্মান করি এবং ইত্যাদি ইত্যাদি।
চলতি সপ্তাহে ইসরাইলের যোগাযোগ মন্ত্রী আইয়ূব কারা আল জাজিরার ইসরাইল-ভিত্তিক সাংবাদিকদের প্রমাণপত্র প্রত্যাহারের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে আল জাজিরার জেরুজালেম ব্যুরো বন্ধ করে দেয়া এবং স্থানীয় কেবল ও স্যাটেলাইট প্রদানকারীদের কাছ থেকে টিভি স্টেশনটির সম্প্রচারের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার কথা জানান।
পশ্চিম তীরে ইসরাইল কর্তৃক আরবদের অধিকৃত ভূমিতে ইহুদীদের বসতি নির্মাণের একজন আজীবন সমর্থক হচ্ছেন এই আইয়ূব কারা। কারার এই ঘোষণার মর্ম হচ্ছে- ‘এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে যা ইসরাইল ভিত্তিক চ্যানেলগুলো নিরপেক্ষভাবে রিপোর্ট করবে।’ অন্য কথায়, তাদের হুমকি দেয়া কিংবা তাদের লাইনের মধ্য নিয়ে আসা।
জেরুজালেমে সহিংসতা উস্কে দেয়ার অভিযোগে বিবি নেতানিয়াহু অনেক দিন ধরেই আল জাজিরার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছেন, বিশেষ করে সাম্প্রতিক জেরুজালেমের হত্যাকাণ্ডের রিপোর্টে তিনি খুবই মনোক্ষুণ্ণ। কিন্তু ইসরাইলের ভিতর ও বাইরে বাইরের প্রায় প্রত্যেক বিদেশি সাংবাদিককে বিভিন্ন সময়ে ইহুদিবিদ্বেষ এবং অন্যান্য মিথ্যা প্ররোচনার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি ইসরাইলের অনুভূতি থেকে আল জাজিরার প্রতিবেদনে দেখতে পাই যে, দেশটির জন্য আল জাজিরার তোষামোদমূলক ভক্তি। যা সত্যিই খুবই বেদনাদায়ক। এরিয়েল শ্যারনের মৃত্যুতে চ্যানেলটি সহানুভূতির বাতা প্রেরণ করেছিল। অথচ এই শ্যারনই ১৯৮২ সালে সাবরা ও শাতিলা শরণার্থী শিবিরে ১,৭০০ ফিলিস্তিনিকে গণহত্যার জন্য দায়ী।
আসলে আইয়ূব কারা তার অনুসারী আরবদের কাছ থেকে তার ধারণাটি গ্রহণ করেছেন এবং তিনি তা স্বীকারও করেন। তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসী সমর্থক মিডিয়ার বিরুদ্ধে ইসরাইল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, যা প্রায় সব আরব দেশ কর্তৃক নিরূপিত হয়েছে এবং আমরা তা নিশ্চিতভাবেই জানি।’
সুতরাং মনে হচ্ছে ইসরাইল এখন আরব দেশগুলো থেকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর পাঠ গ্রহণ করছে। শুধু সৌদি আরবই নয়, বরং প্রায় সব আরব দেশ, বিশেষকরে মিশর, সিরিয়া, জর্দান, আলজেরিয়ার একচ্ছত্র প্রচার মাধ্যমগুলো কি সত্যিই উদারপন্থী প্রেস এবং উপসাগরের সমগ্র মিডিয়া কি আসলেই সত্য বলার দূর্গ, কর্তৃত্ববাদী শাসকদের আক্রমণাত্মক প্রতিপক্ষ, সাংবিধানিকভাবে স্বৈরশাসক গোষ্ঠী থেকে সুরক্ষিত? কিন্তু ইসরাইল কিভাবে নিজেই নিজেকে সংজ্ঞায়িত করতে চায়?
বিচার ছাড়াই কারাবাস, বিচারবহির্ভূত দণ্ড, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি, সামরিক শাসন - এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলো ‘প্রায় সব’ সুন্নি মুসলিম আরব দেশ ও দখলদার ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
এবং একজন সন্ত্রাসী সমর্থক হিসেবে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করছি কেন সুন্নি উপসাগরীয় আরবরা মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে জঘন্য ইসলামনামধারীদের কাছে তাদের যোদ্ধাদের, তাদের অর্থ রপ্তানি করেছে এবং তারপর জিজ্ঞাসা করছি কেন সুন্নিপন্থী আল-নুসরার আহত যোদ্ধাদের ইসরাইলের হাসপাতালে চিকিৎসার দেয়া হয়েছে।
এখনো অনেক সম্মানিত ইসরাইলি রয়েছেন যারা ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি রাষ্ট্রের দাবিকে সমর্থণ করেন। সেখানে অনেক সুশিক্ষিত সৌদি আছেন যারা ওয়াহাবিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে থাকেন। লক্ষ লক্ষ আমেরিকান রয়েছে যারা বিশ্বাস করেন না যে, ইরান তাদের শত্রু এবং সৌদি আরব তাদের বন্ধু।
কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম উভয়েরই সমস্যা হচ্ছে আজ আমাদের সরকার আমাদের বন্ধু নয়। তারা আমাদের নিপীড়ক কিংবা মনিব, সত্যের দমনকারী এবং অন্যায়কারীদের বন্ধু।
নেতানিয়াহু জেরুজালেমে আল জাজিরার অফিস বন্ধ করতে চান। ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ কাতারে আল জাজিরার অফিস বন্ধ করতে চান। বুশ প্রকৃতপক্ষে কাবুল এবং বাগদাদে আল জাজিরার অফিসে হামলা করেছিল। ‘সন্ত্রাসবাদে’ অর্থায়ন নিয়ে সরকারি একটি প্রতিবেদন লুকানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে থেরেসা মে। ঠিক একই কারণে আজ থেকে ১০ বছর আগে ‘বিএই-সৌদি ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ব্লেয়ার যুক্তরাজ্যের পুলিশি তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
এবং ভাবছি কেন আমরা মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে যাই এবং আমরা আশ্চর্য হচ্ছি কেন সুন্নি আইএস এখনো বিদ্যমান। আমি মনে করি সবচেয়ে ভাল হয় আমরা আল জাজিরার উপর নজর রাখি; যেটি এখনো চারপাশে রয়েছে।
লেখক: রবার্ট ফিস্ক। তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
ইন্ডিপেন্ডেন্ট অবলম্বনে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন