দুপুরে ভাত খেয়ে ঘরের দাওয়ায় বসেছিলেন তসলিমা (২৫)। মাদ্রাসা শিক্ষক স্বামী মো.ইউনূস (৪০) তখনও কর্মস্থল থেকে ফেরেননি। হঠাৎ পাড়ায় শোরগোল ওঠে, ‘বর্মি আসিছে, আর্মি আসছে।’ তসলিমা সামনে পান দুই ছেলেকে। ৮ বছরের আব্দুল হান্নান ও এক বছর ৮ মাস বয়সী আব্দুল হাফেজকে নিয়েই পালাতে থাকেন। বৃষ্টির মতো গুলি আসছে। তসলিমা ছেলেদের নিয়ে দৌড়াচ্ছেন। পেছনে তার বাড়িঘরে জ্বলছে আগুন। এরপর আর কিছুই মনে নেই তসলিমার।
পরদিন সকালে গুলিবিদ্ধ তসলিমাকে তার স্বামী খুঁজে পান বাড়ির পাশে ধানক্ষেতে। পায়ে গুলিবিদ্ধ তসলিমা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। বুকের মধ্যে ধরা গুলিবিদ্ধ হাফেজ ও হান্নান। তসলিমাকে জীবিত উদ্ধার করলেও দুই সন্তানের মরদেহ মিয়ানমারে ফেলেই বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন ইউনূস।
তসলিমা ও ইউনূসের সঙ্গে দেখা হয় মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে। সেখানে তসলিমার চিকিৎসা চলছে।
ইউনূস বাংলানিউজকে বলেন, ‘দুই ছেলের লাশ ক্ষেতের মধ্যে ফেলে এসেছি। আমার ওয়াইফকে (স্ত্রী) কাঁধে নিয়ে তাড়াতাড়ি নৌকায় তুলে নিয়ে এসেছি। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে আসার পর আমাদের অস্থায়ী স্বাস্থ্য ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ’
ইউনূসের পরিবারের ১৩ জন গত শনিবার (০৯ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। এদের মধ্যে ইউনূস ও তসলিমা ছাড়াও তাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে, মা ও সৎ মা, তিন ভাই ও এক বোন এবং একজন ভাইয়ের মেয়েও এসেছেন।
গুলিবিদ্ধ হয়ে দুই সন্তান হারানো তসলিমা এখনও স্বাভাবিক হতে পারেননি।
হাসপাতালের কয়েকজন সেবিকা এবং স্বামী ইউনূস বাংলানিউজকে জানান, ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে কান্না করে উঠছেন তসলিমা। বারবার ছেলেদের কথা বলে কাঁদছেন।
হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, ছোট ছেলে হাফেজের কথা বলে দুই চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে তসলিমার। বারবার বলছেন, আমার হাফেজকে এনে দাও। হান্নান কোথায় ?
ইউনূস শুধু দুই ছেলে নয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গুলিতে নিজের বাবা এবং ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকেও হারিয়েছেন।হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তসলিমা, পাশে স্বামী মো.ইউনূস
মিয়ানমারের মংডু জেলার রাচিদং থানার সাহেবপাড়া এলাকা থেকে আসা ইউনূস বাংলানিউজকে জানান, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের পাড়ায় আক্রমণের পর তসলিমা দুই ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। মা সহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও পালিয়ে পাহাড়ের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার বাবা ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রী পালাতে পারেননি। তাদের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। কোনোমতে দুজন বেরিয়ে আসার পর তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়।
ইউনূস মাদ্রাসা থেকে যখন পাড়ায় ফেরেন তখন পুরো পাড়া জনশূন্য। সবাই বেরিয়ে পড়েছেন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। নিজের ঘরের সামনে গিয়ে পান বাবা এবং ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর মরদেহ। ঘরে তখনও আগুন জ্বলছে। স্ত্রী-সন্তানদের পাগলের মতো খুঁজতে থাকেন। পরদিন ভোরে যারা পাহাড়ে লুকিয়েছিল তারা বেরিয়ে আসেন। ধানক্ষেত দিয়ে চলে আসার সময় দেখেন স্ত্রী পড়ে আছে বুকের ওপর দুই ছেলে নিয়ে। স্ত্রী অজ্ঞান হলেও বেঁচে আছেন, দুই ছেলে যে বেঁচে নেই এটা বুঝতে পারেন।
কান্নায় ভেঙে পড়ে তসলিমা বলেন, ‘ছেলে দুইটা চোখের সামনে ছিল। তাদের নিয়েই দৌড়াইছি। তারা যদি না থাকতো, তাহলে বোধহয় বেঁচে যেত। আমি নিজেই আমার ছেলে দুইটারে মেরে ফেলছি। ’
একই গ্রাম থেকে আসা গুলিবিদ্ধ জমিলা খাতুনও (১৫) চিকিৎসা নিচ্ছেন কক্সবাজার সদর হাসপাতালে। দাদি জোহরা খাতুন (৬০) জানালেন, জমিলার বাম বাহুতে গুলি লাগে। পিঠের ওপর দিয়ে সেই গুলি বেরিয়ে যায়।
জোহরার ছেলে মাওলানা সাইদুল্লাহ এবং নাতনি মোছাম্মৎ নূরুচ্ছফাও (৪) মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
শুধু তসলিমার কোল শূন্য হয়নি। কিংবা সন্তান হারানোর ব্যথায় একা কাতরাচ্ছেন না জোহরা। মিয়ানমারে সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী অধিকাংশ রোহিঙ্গা পরিবারের চিত্র এটি।
তসলিমাদের ঘরে ঘরে স্বজন হারানোর কান্না। এই কান্না জানান দেয়, মিয়ানমার রাষ্ট্রে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর কতটা পাশবিক নির্যাতন চলছে!
গত মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর সেখানে নতুন করে সহিংসতা শুরু হয়েছে। নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ এবং ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার পর দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেছেন রোহিঙ্গারা। এর মধ্যে জাতিসংঘ তথ্য দিয়েছে, বাংলাদেশে ইতোমধ্যে সোয়া তিন লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন