চলমান রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের অবস্থান নিয়ে উদ্বেগ কাটছে না। তবে ইতোমধ্যে চীনের পক্ষ থেকে এক ধনের মিয়ানমার প্রীতির ঘোষণা আসলেও মোদী সরকার এ ব্যাপারে এখনও নীরব। যদিও কদিন আগেই স্বশরীরে মিয়ানমার সফর করে এসেছেন মোদী। সেখানে সূ চি’র সঙ্গে হ্যান্ডশ্যাক ও রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে মিয়ানমারের পক্ষে দাঁড়ানোর এক প্রকাশ পরোক্ষ আভাস দিয়ে এসেছেন তিনি। আর সেটাকে পুঁজি করে গোটা ভারতও এখন নীরব ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
কূটনৈতিক মহলেও ভারতের অবস্থান নিয়ে রীতিমতো প্রশ্ন উঠেছে। মোদীর মিয়ানমার সফরকালে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রসঙ্গে কোনও কথা না বলার প্রধান কারণ হতে পারে মিয়ানমারকে চীনের ছত্রছায়া থেকে নিজেদের কব্জায় নিয়া আসা। চীনের বৃত্ত থেকে মিয়ানমারকে ভারতমুখী করা। যৌথ বিবৃতিতে এই প্রসঙ্গ ধামাচাপা পড়ায় মনঃক্ষুণ্ণ বাংলাদেশ।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারে চীনের আগ্রাসী নীতিতে ভারতের এমনিতেই ঘুম হারাম। তার উপর মিয়ানমারও যদি হাতছাড়া হয় তবে মোদীর জন্য তা হবে নতুন আতঙ্কের কারণ। তাই কৌশলগত পরিবর্তন চান মোদীও। কেননা, ভারতের কাছে মিয়ানমারের গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে।
অন্যদিকে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে ভারতের ভৌগোলিক যোগসূত্র মিয়ানমার৷ ‘লুক ইস্ট’ পলিসি কার্যকর করতে ইয়াঙ্গুনের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও মজবুত করা দরকার, সম্ভবত এমনটা মনে করেই চীনে ব্রিকস সম্মেলন শেষে ফেরার পথে ইয়াঙ্গুন সফরে অং সান সু চি ও মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করে এসেছেন মোদী।
তবে গেল ৬ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার সফর শেষে দেয়া যৌথ বিবৃতিতে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানের কোনও উল্লেখ নেই। সম্ভবত মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে চাইছে না বলেই যৌথ বিবৃতিতে মুখ খুলেননি মোদী। উল্টো মিয়ানমার সরকার বলছে- রোহিঙ্গারা নাকি রাখাইন প্রদেশে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত৷ তারা নাকি নিরাপত্তা বাহিনির ওপর হামলা চালাচ্ছে।
অথচ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে কিংবা এ সমস্যার সমাধানে মোদী মিয়ানমার সরকার তথা সু চি’কে রাজি করাবেন- এমনটিই আশা করছিল কূটনৈতিক মহল ও বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু সব আশার গুড়ে বালি ছিটিয়ে তবেই ফিরলেন মোদী।
তবে মোদীর নীরবতায় অনেকটাই আশাহত বাংলাদেশ। কিছুটা মনোক্ষুণ্নও। যদিও রাখাইন প্রদেশে হিংসা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী, কিন্তু একটি বারের জন্যও রোহিঙ্গা ইস্যু উচ্চারণ করেননি তিনি৷ উল্লেখ করা হয়েছে, রাখাইন প্রদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভারতের সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা৷ কূটনৈতিক সূত্রের একাংশের বক্তব্য, প্রকাশ্যে না বললেও অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠকে সম্ভবত রোহিঙ্গা ইস্যু তুলেছিলেন মোদী৷
চলমান রোহিঙ্গা ইস্যুটি যে শুরু বাংলাদেশের সমস্যা তা কিন্তু নয়। ইতোমধ্যে ভারতেও প্রায় অর্ধলক্ষের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী ঢুকে পড়েছে। বাংলাদেশে এসেছে প্রায় ৩ লাখ। ফলে ইচ্ছে না থাকলেও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবাচ্ছে দিল্লিকে। এ নিয়ে গত শনিবার ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জয়শংকরের সঙ্গে বৈঠক করেন নয়া দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী৷
হাইকমিশন সূত্রে বলা হয়, রোহিঙ্গা সমস্যার মানবিক সমাধানের জন্য ইয়াঙ্গুনের ওপর চাপ বাড়াতে চাইছে ঢাকা৷ সেজন্য দিল্লিকে পাশে পাওয়া দরকার৷ বৈঠকের পরই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরেকটি বিবৃতি প্রকাশ করে দিল্লির অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়৷ তাতে বলা হয়, রাখাইন প্রদেশের হিংসা এবং ওই অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নজনিত পরিস্থিতিতে ভারত উদ্বিগ্ন৷ ঢাকা এই বিবৃতিকে স্বাগত জানিয়েছে৷
একই সঙ্গে গত সপ্তাহে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত ভারত মহাসাগরীয় সম্মেলনের পার্শ্ব বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে মতবিনিময় হয় পররাষ্ট্র সচিব জয়শংকর এবং বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের মধ্যে৷ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে বাংলাদেশে যে মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে, তার প্রতি তিনিও দিল্লির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন৷
এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যু ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের একটা মাপকাঠি৷ শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে প্রচণ্ড চাপের মুখে, সেটা দিল্লির অনুধাবন করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন নয়া দিল্লির পূর্বতন বাংলাদেশ হাইকমিশনার তারেক করিম।
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল বলছে, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি অনুসারে, বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতবিরোধী জঙ্গি তত্পরতা দমনে ঢাকা যে সাফল্য দেখিয়েছে ভারত সে কথা নিশ্চয় এত দ্রুত ভুলে যাবে না। এখানে ঢাকার প্রতি দিল্লির একটা কৃতজ্ঞতারও জায়গা আছে। তবে ভারতে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে দিল্লি সরকার মরিয়া হয়ে উঠলেও মোদীর বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেকটা মানবিক বিবেচনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার বলছে- রোহিঙ্গারা উদ্বাস্তু। তারা আমাদের রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের জোর করে তাড়িয়ে দেয়া হবে না। মানবিকতার জায়গা থেকেই তাদের এই রাজ্যে থাকতে দেয়া হবে।
যদিও অনুপ্রবেশকারী ওই ৪০ হাজার রোহিঙ্গা নিয়ে দিল্লি সরকারের মধ্যে এক ধরনের ভয় তো আছেই। দিল্লির ভাবনা- বর্তমানে ভারতে অবস্থানকারী ৪০ হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার রয়েছে জম্মু-কাশ্মীরে সীমান্তে। বাকিরা পাশের অন্যান্য রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে। কোন রাজ্যে কত সংখ্যক রোহিঙ্গা আছে, তা খতিয়ে দেখতে প্রতিটি রাজ্যকে একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে বলা হয়েছে। ভারতের ভবিষ্যত জাতীয় নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে দিল্লি সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠাতে মরিয়া।
অবশ্য চলমান রোহিঙ্গা ইস্যুতে অনেকেই ভারতের অতীতের দৃষ্টান্ত তুলে ধরছেন। যেখানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতকে এতটা স্পর্শকারত না হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে দেশটির সাধারণ নাগরিকগণ। তারা বলছেন, অতীতে ভারত যদি তিব্বতি, পাখতুন ও সিংহলি এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ বাঙালিকে আশ্রয় ও আহার দিয়ে মানবিক সহায়তায় নজির সৃষ্টি করতে পারে তবে এখন সমস্যা কোথায়? তিব্বতি, পাখতুন, সিংহলি কিংবা বাঙালিরা যদি আশ্রয় পাওয়ার পর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তায় বিঘ্ন না ঘটিয়ে থাকে তবে রোহিঙ্গাদের পক্ষে সেটি করা কতটা সম্ভব? রোহিঙ্গারাইবা কেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকির কারণ হতে যাবে?
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন