রাখাইন রাজ্যে গত ২৫ আগস্ট পুলিশের বেশ কিছু চৌকিতে হামলার পর সেখানে সেনা অভিযান ঘিরে সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতি এবং রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে চীন, রাশিয়া ও ভারতসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশকে পাশে পেলেও পশ্চিমা বিশ্বের তীব্র সমালোচনার মুখে রয়েছে মিয়ানমার।মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বলছে, পুলিশের চৌকিতে হামলার জন্য রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) দায়ী এবং তাদের দমন করতেই রাখাইনে সেনা অভিযান চালানো হচ্ছে। এছাড়া রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরাই রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে বলেও দাবি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের।
তবে রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে পালিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢোকা প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গার বেশির ভাগই বলছে, সন্ত্রাস দমনের নামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা করছে এবং তাদের ঘরাবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
এমন অবস্থায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে মিয়ানমার। বিশেষ করে দেশটির স্টেট কাউন্সিলর শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চির সমালোচনাই বেশি হচ্ছে। তার সমালোচনায় মুখর হয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ীরাও। সরকারে থেকেও রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কার্যকর কোনো ভূমিকা না রাখার কারণেই মূলত তাকে ঘিরে এ সমালোচনা।
মালালা ইউসুফজাইসহ নোবেলজয়ী পাঁচ নারী রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সু চিকে নীরবতা ভেঙে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। শান্তিতে নোবেলজয়ী তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা দালাই লামা রাখাইনে শান্তি ফেরাতে সু চিকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া শান্তিতে নোবেলজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুও এ ইস্যুতে সু চিকে নীরবতা ভাঙার আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্যদিকে গত ১২ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের ২৯টি রাজনৈতিক দল এক বিবৃতিতে ১৯৮২ সালে করা দেশটির নাগরিক আইন পরিবর্তন না করার দাবি জানিয়েছেন সরকারের প্রতি, যে আইনে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। বিবৃতিতে তারা আরও বলেছে, সংবিধান রক্ষায় প্রয়োজনে সেনা হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। মিয়ানমারের বিরোধী দলগুলোর এমন দাবি সু চির জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি রাখাইনে শান্তি ফেরাতে কী করবেন? তিনি কি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দাবি মেনে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের উদ্যোগ নেবেন? নাকি দেশের বিরোধী দলগুলোর দাবি মেনে নেবেন?এক্ষেত্রে তিনি যদি আন্তর্জাতিক চাপ সামাল দিতে ১৯৮২ সালের নাগরিক আইনে পরিবর্তন এনে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেন তবে তাতে দেশের ভেতরে তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে পারে এবং ফলস্বরূপ দেশটিতে আবারও সামরিক শাসন ফিরে আসতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুড সু চির অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন বিপজ্জনক একটি দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটা একজন মানুষের সঙ্গে, যে দড়ির এক প্রান্তে রয়েছে 'রোহিঙ্গাদের জন্য ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করা এবং অপর প্রান্তে মিয়ানমারের সদ্যজাত গণতন্ত্র ধ্বংস করতে সেনাবাহিনীকে না থামানো।''এক্ষেত্রে তার হোঁচট খাওয়া ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে' বলে গত ৯ সেপ্টেম্বর বাজফিড নিউজে লেখা নিজের এক কলামে উল্লেখ করেন তিনি। তার মতে, মিয়ানমার এখনও ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ওই লেখায় রুড দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন— অং সান সু চি দেশটির বেসামরিক প্রধান, সেনাপ্রধান নন এবং ২০০৮ সালে দেশটির সামরিক বাহিনী প্রণীত সংবিধান, যেখানে মিয়ানমারে শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনে সেনা অভ্যুত্থানকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সীমান্ত মন্ত্রণালয়সমূহ এখনও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।কেভিন রুডের মতে, রোহিঙ্গা ও মিয়ানারের অন্য ৫ কোটি মানুষের অবস্থার উন্নতি হবে না 'যদি না আমরা গত অর্ধ শতাব্দীতে দেশটির একমাত্র গণতান্ত্রিক সরকারকে নিন্দা জানাই ও তাদের পরিত্যাগ করি।'
মিয়ানমারে শান্তি ফেরানোর একটি পথও বাতলে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। বাজফিড নিউজে লেখা কলামটি রুড শেষ করেছেন এই বলে যে, 'গণতান্ত্রিক পরিবেশে আইনের শাসনের মধ্য দিয়েই শান্তি, ন্যায় বিচার এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব, সামরিক শাসন ফেরানোর মাধ্যমে নয়।'সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা অং সান সু চি রাখাইনে শান্তি ফেরাতে কোন পথে হাঁটেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
samakal
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন