শ্রীলঙ্কায় নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, দেশটির রাজনীতিতে নানা মাত্রার পরিবর্তন ততই বাড়ছে। সরকার টিকে থাকতে চাইবে আর বিরোধী দল ক্ষমতায় আসতে চাইবেÑ এটাই স্বাভাবিক। শ্রীলঙ্কাতেও তা হচ্ছে। তবে বেশ ভিন্নভাবে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপাকসে ক্ষমতায় ফেরার জন্য নতুন যে চাল সাজিয়েছেন, তার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয়েছে তার ভাই এবং প্রভাবশালী সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোতাভায়া রাজাপাকসেকে। উগ্র সিংহলি-বৌদ্ধপন্থী জাতীয়তাবাদের ত্রাতা হিসেবে পরিচিত গোতাভায়া যদি আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তবুও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
শ্রীলঙ্কায় আগামী বছরই হবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
আর তাতে উগ্র বৌদ্ধবাদ বিশেষ গুরুত্ব পেতে যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। আর এই উগ্রবাদে ভর করেই মাহিন্দ রাজাপাকসে ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্ন দেখছেন। অবশ্য তিনি নিজে প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। ২০১৫ সালে সংবিধানে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে কারো পক্ষে দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্ভব নয়। মাহিন্দ ইতোমধ্যে দুইবারের মেয়াদ পূর্ণ করে ফেলেছেন (তিনি ২০০৫ থেকে ২০১০ এবং ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ছিলেন)। তিনি হয়তো প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। পারিবারিকভাবে রাজাপাকসেরা রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়। গোতাভায়া রাজাপাকসে ছাড়াও মাহিন্দ রাজাপাকসের আরো দুই ভাই বাসিল রাজাপাকসে এবং চমল রাজাপাকসে ইতঃপূর্বে মন্ত্রী ছিলেন।
এই দুই ভাই গোতাভায়ার মতো তত উগ্র নন। এ কারণেই তাকেই টেনে আনা হয়েছে। বর্তমানে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, অদূরভবিষ্যতেও সম্ভবত কারো আবির্ভাব ঘটবে না। সম্প্রতি পদচ্যুত বিচারমন্ত্রী বিজয়দাসা রাজাপাকসে (রাজাপাকসেদের সাথে সম্পর্কহীন) দুই বছর ধরে উগ্র সিংহলি বৌদ্ধ জাতীয়বাদী ইমেজ তৈরি করলেও তার মধ্যে রাজাপাকসের মতো ঐতিহ্য ও ক্যারিশমা নেই। জি এল পেইরিসের মতো রাজনীতিবিদেরা ডাকসাইটে মন্ত্রী হিসেবে বিরাজ করলেও তারা প্রেসিডেন্ট পদে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী হতে পারবেন না। রাজাপাকসেরা যেভাবে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাতে করে সিংহলি বৌদ্ধরা প্রেসিডেন্ট পদে তাদেরই কাউকে দেখতে চাইতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি গোতাভায়া রাজাপাকসের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ইলিয়া’ বা ‘আলো’ নামে নতুন একটি আন্দোলনের সূচনা ঘটানো হয়েছে। রাজাপাকসেদের প্রতি পেশাদার, শিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের সমর্থন লাভের জন্য ‘ইলিয়া’ আন্দোলনের সূচনা করা হয়েছে।
ইলিয়া আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে নতুন সংবিধান প্রণয়নে ব্যস্ত প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা এবং প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের বর্তমান ঐক্য সরকারের পতন ঘটানো। নতুন সংবিধানে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হ্রাস করে প্রদেশগুলোর কাছে আরো বেশি ক্ষমতা হস্তান্তরের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোতাভায়া মনে করেন, নতুন সংবিধান তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এমন ক্ষমতা দেবে, যা তারা সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমেও হাসিল করতে পারেনি। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি উদার মনোভাবাপন্ন বর্তমান সরকারের সদস্যদের এই উদ্যোগ প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। শ্রীলঙ্কার ৭৫ ভাগ লোক বৌদ্ধ। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার গ্রামীণ এলাকায় বৌদ্ধরাই একচ্ছত্রভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থানে আছে। তাদের সমর্থন নিয়ে উদারপন্থীদের প্রয়াস ভণ্ডুল করে দিতে পারবেন বলে আশাবাদী গোতাভায়া।
অবশ্য বর্তমান সরকারের কিছু পদক্ষেপও রাজাপাকসেদের এগিয়ে যাওয়ার পথ সৃষ্টি করে দিয়েছে। বিশেষ করে সম্প্রতি জারি করা নতুন কর আইনের ফলে অনেকের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এটাও রাজাপাকসেরা কাজে লাগাতে চান। বৌদ্ধধর্ম বা জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর পরিকল্পিত আঘাতের কথা বলেও সহানুভূতি কাড়ার চেষ্টা করছেন তারা। আবার বর্তমান সরকারের প্রতি তামিল ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের অসন্তুষ্ট থাকার কারণ রয়েছে। তামিল আর মুসলিমদের ভোটেই সিরিসেনা ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু উগ্র জাতীতাবাদ দমনে তিনি খুব বেশি কিছু করতে পারছেন না।
এতে করে তারা কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছে। মুসলিমদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সাম্প্রতিক হামলায় সরকারকে নিষ্ক্রিয় দেখা গেছে। আবার উত্তরে তামিলরা তাদের মালিকানা থেকে বাজেয়াপ্ত করা ভূমি এখনো ফেরত পায়নি। এ কারণে তারা বর্তমান সরকারের প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারছে না। তা ছাড়া বর্তমান সরকার জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠাতেও খুব একটা এগোতে পারিনি। এমন এক অবস্থায় ইলিয়া আন্দোলন যাত্রা শুরু করেছে। গোতাভায়া রাজাপাকসে জোর গলায় বলেছেন, তার ইলিয়া আন্দোলন কোনো অবস্থাতেই সরকারকে দেশের সাথে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করতে দেবে না।
নতুন আন্দোলন চাঙ্গা হোক বা নিষ্প্রভ হয়ে পড়–কÑ যা-ই হোক না কেন এটা ঠিক, রাজাপাকসেরা ২৪ ঘণ্টাই বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে লড়বে, ক্ষমতায় ফিরে যেতে কোনো কিছুই বাদ রাখবে না। তবে সরকারও বসে নেই। সরকার এখন রাজাপাকসেদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর গতি বাড়াচ্ছে।
এ দিকে সরকারও ইলিয়া আন্দোলনের মতো কোনো বড় ধরনের গণসচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ করে কি না সেটা দেখার বিষয়। বিশেষ করে নতুন সংবিধান নিয়ে তারা জনগণের কাছে যাওয়ার কথা বলছে। তারা বলতে চাইছে, নতুন সংবিধান এককেন্দ্রিক সরকারের জন্য হুমকি নয়। এই সরকার দেশের স্বার্থের জন্য হানিকর কোনো কিছুই করবে না। তবে এ দিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ কতটুকু দমন করা যাবে, তা সময়ই বলে দেবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন