দীর্ঘ দিনের সিরিয়া সঙ্কটের শেকড়টা কোথায় তা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ইস্যুটি যারা ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছেন তারা বলছেন, কারো কারো কাছে আশ্চর্যজনক হতে পারে কিন্তু সামনের দিনগুলোতে এরকমটি হওয়ারই সম্ভাবনা রয়েছে। হয়তো আগামী ছয় বছরের মধ্যেই সিরিয়া যুদ্ধের অবসান হয়ে যেতে পারে। সিরীয় পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে সঙ্কটের শেকড়টি সিরিয়া থেকে এক হাজার মাইল দূরের উপসাগরীয় এলাকায় প্রোথিত। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর এবং এ দেশগুলোর মিত্ররা চেষ্টা করছে কাতারকে একঘরে করে রাখতে। এটি এ সময়ের একটি উত্তপ্ত কূটনৈতিক সঙ্কট। অনেকেই বলছেন, সিরীয় সঙ্কটের সমাধানটিও এখানেই।
সিরিয়ার সরকারবিরোধী জোটের আন্তর্জাতিক সমর্থকেরা এখন পর্যন্ত বাশার সরকারের বিরোধিতা করে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও উপসাগরীয় দেশগুলো এবং তুরস্ক এখন নতুন কৌশলে সামনে যেতে চাচ্ছে। এ দেশগুলো চাচ্ছে যে তারা সিরিয়ার বাশার সরকারের পতন নয়, বরং তাকে ক্ষমতায় রেখেই সমস্যার সমাধান করতে। এ দেশগুলো মনে করছে এত দিনকার যুদ্ধের এভাবেই অবসান হবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা এভাবেই ফিরে আসবে।
এ দিকে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি ঘটনা নিরবে-নিঃশব্দে ঘটে গেছে। উত্তর কোরিয়া সমস্যা, রাশিয়ার নতুন অস্ত্রের পরীক্ষা, দক্ষিণ সাগরে চীনা দ্বীপ এবং সাম্প্রতিক মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে বিতাড়ন নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়া এখন ভীষণ ব্যস্ত। ফলে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদেল আল জুবেইর যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সিরিয়ার বিরোধী জোট ‘সিরিয়ান ন্যাশনাল কোয়ালিশনের (এসএনসি) সদর দফরে বৈঠক করে এসেছেন তা মিডিয়ার নজর এড়িয়ে গেছে। আবদেল আল জুবেইর সেখানে উপস্থিতদের জানিয়েছেন, সিরীয় সঙ্কটের নতুন সমাধান খুঁজে বের করার সময় এসেছে।
এর মধ্যে সিরিয়ার স্বার্থ এবং এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর স্বার্থও প্রতিফলিত হবে। আবদেল জুবেইরের বার্তাটি স্পষ্টভাবে বিবৃত না হওয়ায় এসএনসির মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তিও সৃষ্টি হয়েছে। তা সত্ত্বেও বর্তমানে এটা খুব স্পষ্ট হয়ে সামনে চলে এসেছে যে সিরিয়ার বিরোধী পক্ষ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। বাশার সরকার ও তার রাজনৈতিক মিত্রদের সম্মিলিত শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উপসাগরীয় কূটনীতিতে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান অবস্থাকে বদলে দিয়েছে।
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কূটনৈতিক তৎপরতা সৌদি সরকার প্রকাশ্যে অস্বীকার করলেও মন্ত্রীর সিরিয়াবিষয়ক তৎপরতা বৃদ্ধি এটাই স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, সিরিয়ার ক্ষমতায় বাশার আল আসাদকে মেনে নিতে সৌদি আরবের আপত্তি নেই এবং তাকে উৎখাত করার পরিকল্পনা থেকে সৌদি আরব সরে এসেছে। মনে হচ্ছে সৌদি আরব সঙ্ঘাত থেকে সরে এসে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে যাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের নতুন আকার দেয়ার জন্য হয়তো এসএনসির বর্তমান প্রধান রিয়াদ হিজাবকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে সাবেক প্রধান এবং টুমরো মুভমেন্টের নেতা আহমেদ আল জারবাকে বসানো হতে পারে। আহমেদ আল জারবার প্রতি সৌদির মনোভাব বেশ নমনীয়। জারবার ইতোমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন যে, ‘সিরিয়া সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে সহজ ও বাস্তব সমাধান হলো মস্কোর সাথে কথা বলা এবং অলিক স্বপ্ন দেখা থেকে বিরত থাকা।’ তার এসব উক্তির বিরোধিতা সৌদি আরব করছে না। এ দিকে তুর্কি সরকারের তৎপরতাও প্রমাণ করছে যে তারা সিরিয়া সরকারের বিরোধিতা থেকে সরে আসছে। তুর্কি সরকার এসএনসিকে প্রতি মাসে যে তিন লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার দিয়ে আসছিল তাদের কর্মকর্তাদের বেতন হিসেবে, তা কমিয়ে এনেছে। ফলে এসএনসির কোয়ালিশন সদস্যদের মাসিক বেতন কমে গেছে।
সিরীয় সঙ্কটে উপসাগরীয় বিরোধের আমরা যদি একটি যৌক্তিক উপসংহার টানি তাহলে দেখতে পাবো সৌদি, আরব আমিরাত ও মিসরের অভিযোগ যে কাতার ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। অন্য দিকে কাতারের প্রধান আঞ্চলিক মিত্র তুর্কিরা। ইরান, কাতার ও তুর্কিদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়েছে তাতে এদের সাথে সৌদি জোটের কোনো আলোচনা হলে তা অবশ্যই ইরানের আরেক ঘনিষ্ঠ মিত্র বাশার আল আসাদকে সংযুক্ত করতেই হবে।
অন্য দিকে জর্দানের মধ্যস্থতায় সিরিয়ার হোমসে যুদ্ধবিরতিকে সৌদি আরব মেনে নিয়েছে। জর্দান সিরিয়ার ঘউতায় যুদ্ধবিরতিতে কাজ করে যাচ্ছে এবং সম্ভবত সংযুক্ত আরব আমিরাত সিরিয়ার স্থিতিশীলতা আনয়নে নতুন তৎপরতায় নীরব থাকছে এবং আপত্তি করছে না। তদুপরি আবুধাবি সিরিয়ার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পরোক্ষভাবে ইচ্ছাও প্রকাশ করেছে।
সৌদি অথবা আরব আমিরাতের সিরিয়া প্রশ্নে হঠাৎ নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শনের অন্তর্নিহিত আরেকটি উদ্দেশ্য হলো এ দেশগুলো মিসর থেকে উদ্ভূত মুসলিম ব্রাদারহুডকে কোনোভাবে সফল হতে দিতে চায় না। এ সংগঠনটি যেন সিরিয়া সমস্যা সমাধানে কোনো প্রকার ভূমিকা পালন করতে না পারে এ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে মিসরসহ উপসাগরীয় দেশগুলো। এরা এখন আরেক শিয়াশাসিত সিরিয়াকে তেমন হুমকি মনে করছে না, যতটা মুসলিম ব্রাদারহুডকে মনে করে। মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রভাব বাড়লে উপসাগরীয় দেশগুলোর রাজতন্ত্র নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে এ ভাবনা থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সমীকরণ হতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন