চীন ও ভারত ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের সেরা পাঁচ দুর্ধর্ষ এলিট সেনাবাহিনীর মধ্যে তাদের স্থান নিশ্চিত করতে যাচ্ছে। কেন্টাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাটারসন স্কুল অব ডিপ্লোমেসি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশাল কমার্স-এর সিনিয়র লেকচারার রবার্ট ফারলে এমনটাই মনে করছেন।
তার হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পাঁচটি সেনাবাহিনী হবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া ও ভারত। তিনি যুক্তরাজ্য ও পাকিস্তানকে এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনা করেননি।
পঞ্চম: ভারত
ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচ্চ মর্যাদা লাভের ব্যাপারে তার অভিমত হচ্ছে, এই বাহিনী তীব্র উত্তেজনার মধ্যে বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেয়, দেশে মাওবাদী অভ্যুত্থান মোকাবিলা, কাশ্মিরে পাকিস্তান-সমর্থিত বিদ্রোহ দমন এবং এছাড়া দেশে নানা ধরনের ছোটখাট অভিযানে নিয়োজিত থেকে তারা সমৃদ্ধ হচ্ছে।
তিনি বলেন, একইসাথে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অতি তীব্র মাত্রার যুদ্ধের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। এই লক্ষ্যে তারা বাস্তবসম্মত যুদ্ধ প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেছে।
এসব অভিজ্ঞতার কারণে বাহিনীটি নয়া দিল্লির বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতির কার্যকর অস্ত্রে পরিণত হয়েছে।
সরঞ্জাম ইস্যু
ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আধুনিক সরঞ্জাম সংগ্রহ একটি বড় ইস্যু। ভারত এখন আমদানি-নির্ভরতা কাটানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি উল্লেখ করেছেন, দেশে অস্ত্র তৈরির দিক থেকে ভারত অনেক পিছিয়ে থাকলেও তারা এখন পুরো সামরিক প্রযুক্তির বিশ্বে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। রাশিয়া, ইউরোপ, ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র- সবাই তাদের সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি ভারতের কাছে বিক্রি করছে। এর ফলে ভারতের অভ্যন্তরীণ সামরিক শিল্প কমপ্লেক্স বেশ চাঙ্গা হচ্ছে।
তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, বিমান ও নৌবাহিনীতেও প্রতিযোগিতা করার প্রয়োজন থাকলেও ভারতীয় সেনাবাহিনী এখন অতীতের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত প্রযুক্তি করায়ত্ত করবে। এর ফলে তারা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠছে।
চতুর্থ: ফ্রান্স
ইউরোপের সব দেশের মধ্যে ফ্রান্স তার সবচেয়ে সক্ষম, ভয়াবহ সেনাবাহিনী হিসেবে ভবিষ্যতে তার অবস্থান বহাল রাখতে পারবে। ফারলের মতে, ২০৩০ সাল নাগাদ ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর আন্তর্জাতিক গুরুত্ব লোপ পাওয়াটা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয় হবে।
তিনি বলেন, বিশ্ব রাজনীতিতে একটি প্রধান শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ফ্রান্স। আর তা থেকেই সে মনে করে, সেনাবাহিনীই তার সেই ভূমিকা পালন করতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে। ভবিষ্যতেও এটা বহাল থাকবে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে সামরিক ও নিরাপত্তাব্যবস্থায় ফ্রান্স তার অবস্থান মজবুত করবে বলেই মনে হচ্ছে।
ফ্রান্সের সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্স অভ্যন্তরীণ ও রফতানি- উভয় দিক থেকেই শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। ফরাসি সেনাবাহিনীর রয়েছে আধুনিক কমান্ড ও যোগাযোগ সরঞ্জাম। দেশটি বহুজাতিক ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মেরুদ-তে পরিণত হবে। ট্যাঙ্ক ও গোলন্দাজ শাখাতেও এর শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। ফরাসি সরকারও সেনাবাহিনীর অনুকূলে তার দেশীয় অস্ত্র শিল্পকে শক্তিশালী হিসেবে বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তাছাড়া এই বাহিনীর বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। বিশেষ করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আফগান ও উত্তর আফ্রিকা রণাঙ্গনে তারা লড়াই করেছে। স্থানীয়দের সহায়তায় দেশটির নিয়মিত ও এলিট ফোর্স শত্রুকে পরাজিত করে আসছে।
ফরাসি সেনাবাহিনী নৌবাহিনীর কাছ থেকেও বিপুল সহায়তা পেয়ে আসছে। তাদের বিমান বাহিনীও নিয়মিত সহায়তা দিয়ে থাকে। পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে প্রস্তুত এই বাহিনী সহজেই বিস্তৃত এলাকায় মোতায়েন করা যায়।
তৃতীয়: রাশিয়া
স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তীকালে রুশ সেনাবাহিনী ছিল খুবই খারাপ অবস্থায়। তবে তারা অল্প সময়ের মধ্যেই কার্যকর বাহিনী হিসেবে তাদের অবস্থান ফিরে পায় বলে জানিয়েছেন ফারলে।
তিনি বলেন, রুশ অর্থনীতির উন্নয়নের ফলে রুশ সামরিক বাহিনীতে বিনিয়োগ বাড়ে। রুশ বাহিনীতে বড় ধরনের সংস্কার সাধন করা হয়। এর ফলে তাদের পক্ষে চেচনিয়া যুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব হয়। ২০০৮ সালে রুশ সেনাবাহিনী অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে জর্জিয়াকে পরাজিত করে। ২০১৪ সালে তারা ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়ায় দখল করে নেয়।
রাশিয়ার আশপাশের এলাকায় রুশ সেনাবাহিনী এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
ফারলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, রুশ সেনাবাহিনী ২০৩০ সাল নাগাদ ভয়ঙ্কর বাহিনী হিসেবে বহাল থাকলেও তাদের কিছু সমস্যা থাকবে। ভবিষ্যতে প্রযুক্তি করায়ত্ত করা তাদের জন্য বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে। তাদের বাহিনীতে উদ্ভাবন ও উৎপাদন নিয়েও সমস্যা রয়ে গেছে এবং থাকবে।
তার মতে, জনশক্তিও সমস্যা হিসেবে থেকে যেতে পারে। এর কারণ হলো রুশ সেনাবাহিনী প্রাচীন মডেল আর স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী – কোন মডেল ধরে এগুবে, তা নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে।
কিন্তু তারপরও রাশিয়ার প্রতিবেশীরা এখনো রুশ সেনাবাহিনীর আকার এবং এর শক্তিকে ভয় পায়। এই ভয়টা আরো অনেক দিন বহাল থাকবে।
দ্বিতীয় : যুক্তরাষ্ট্র
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বমঞ্চে আবির্ভাব ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের। তাদের প্রাধান্য ২০৩০ সালেও বহাল থাকবে। ফারলের মতে, এই বাহিনীই ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ হিসেবে বিরাজ করবে।
ইরাকের বিরুদ্ধে প্রচারণা ছিল স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে স্থল যুদ্ধের অবাক করা কৃতিত্ব।’ গত ১৫ বছর ধরে ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ অপারেটররা আরো অনেক দূরে গেছে।
তিনি বলেন, মার্কিন সেনাবাহিনী গত ১৫ বছরে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিপুল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধ করার এটা একটা রেকর্ড। অবশ্য এমন অভিজ্ঞতার ফলে সাংগঠনিক ক্লান্তি চলে আসার বিপদও রয়েছে। ইরাক ও আফগানিস্তানর যুদ্ধগুলোর দৃশ্যত সীমাহীন প্রকৃতি বিশেষভাবে উদ্বেগের বিষয়।
কিন্তু তারপরও ২০৩০ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীই বিশ্বের শক্তিশালী সেনাবাহিনী হিসেবে বিরাজ করবে। আর তাদের এগিয়ে থাকার ব্যবধানটা হবে অনেক বেশি।
প্রযুক্তিগত সুবিধা
সামরিক উদ্ভাবনের দিক থেকে মার্কিন সেনাবাহিনীর অবস্থান অপ্রতিহত। তারা এখনো কিছু সামগ্রী স্নায়ুযুদ্ধকালের, তবে আধুনিকায়নের কাজও তারা করেছে অনেক। ড্রোন ইত্যাদি দিক থেকে তারা অনেক অগ্রসর।
প্রথম: চীন
চীনা সেনাবাহিনী কেবল আধুনিক সরঞ্জামই সংগ্রহ করছে না, বরং সেইসাথে সদস্য সংখ্যার দিক থেকে আমেরিকার মতো ‘কার্যকর ও সফল’ বাহিনীতে পরিণত হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘১৯৯০-এর দশকের প্রথম থেকে পিপলস লিবারেশন আর্মি তাদের সেনাবাহিনীতে পুরোদস্তুর সংস্কার কাজ চালাতে থাকে। দশকের পর দশক ধরে পিএলএ’র উপাদানগুলো চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বিশেষ রাজনৈতিক বিভাগের নিশ্চয়তাদাতা হিসেবে কাজ করেছে। সংস্কারে বলা হয়েছে, পিএলএ সামরিক বাহিনীর মতোই বাণিজ্যিক সংগঠনে পরিণত হয়ে ছোট ছোট উদ্যোগের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করছে।’
তিনি বলেছেন, ‘১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে চীনা অর্থনীতির বিপুল সম্প্রসারণের ফরে পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। তহবিল প্রাপ্তি এবং ক্রমবর্ধমান হারে উদ্ভাবনমুখী প্রযুক্তির ফলে পিএলএ’র উপাদানগুলো আকার ছোট হয়ে আধুনিক সামরিক সংস্থায় পরিণত হয়।’
তিনি বলেন, সংস্কারের মধ্যে ছিল বিপুল সরঞ্জাম আধুনিকায়ন প্রকল্প, বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষণ এবং পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ। মার্কিন সেনাবাহিনীর মতো তহবিল পিএলএ না পেলেও প্রায় সীমাহীন জনশক্তি ছিল তাদের। বিশ্বের প্রায় যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি সম্পদ তারা নিয়ন্ত্রণ করত।’
অন্যান্য শাখার সাথে ব্যবহার
আমেরিকান প্রতিপক্ষদের মতো পিএলএ’র স্থল বাহিনীকে অন্যান্য বাহিনীর সাথে তথা বিমান ও নৌবাহিনীর আর্থিক সুবিধা ভাগাভাগি করে নিতে হয়।
একসময় চীন নৌ ও বিমান শক্তিকে অগ্রাহ্য করে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার দিকে নজর দিয়েছিল। কিন্তু এখন আর সে দিন নেই।
যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই
চীনা সামরিক বাহিনী একটি দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে, সেটা হলো সত্যিকারে যুদ্ধ সম্পর্কে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তবে পিএলএকে আধুনিকায়ন ও সংস্কার করার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে আগামী ১৫ বছরের দিক পরিবর্তন ঘটবে।
সাফল্যের শর্ত
ফারলে মনে করেন, যেসব দেশের মধ্যে উচ্চ মানব মূলধন-সংবলিত উদ্দীপ্ত জনসংখ্যা রয়েছে, তারাই সবচেয়ে উদ্ভাবনী প্রযুক্তির অধিকারী হয়, আধুনিক অর্থনীতি থাকে থাকে। আর তাদের বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক ভারসাম্যপূর্ণ থাকায় তারা খুব বেশি স্বাধীনতা না পেলেও পর্যাপ্ত ভূমিকা পালনের মতো শক্তিশালী থাকে। আর যুদ্ধ অভিজ্ঞতা তাদের সহায়তা করে।
তবে পরিশেষে ফারলে সতর্ক করে দিয়েছেন, জবাবগুলোর সরলতা কিন্তু বোঝাচ্ছে না, নির্ধারিত ব্যবস্থাপত্র খুব সহজে অর্জন করা সম্ভব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন