ইয়েমেনে শিশু অধিকার লঙ্ঘণের দায়ে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটকে কালো তালিকাভুক্ত করতে জাতিসংঘের প্রতি দাবি জানিয়েছে বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন। ফাঁস হওয়া জাতিসংঘের শিশু ও সশস্ত্র সংঘাত বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনের খসড়ায় তাদের দাবির প্রতিফলন হিসেবে সৌদি জোটকে তালিকায় দেখা যায়।
প্রতিবেদনটি বৃহস্পতিবার নিরাপত্তা পরিষদে পেশ করার কথা রয়েছে। (সূত্র: আল জাজিরা)
গত বছরের প্রতিবেদনে ইয়েমেন যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট শুধুমাত্র সৌদি জোটের নামই তালিকায় ছিলো না। যদিও ২০১৬ সালের সেই প্রতিবেদনে প্রথমে তাদের নাম থাকলেও পরে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন ‘সাময়িকভাবে’ তাদের নাম প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি তখন গাল্ফ দেশগুলোর ‘অগ্রহণযোগ্য’ চাপের কথা বলেছিলেন। জাতিসংঘে অর্থায়ন বন্ধ করার হুমকি দিয়েছিলো সৌদি আরব।
সৌদি জোটের নাম সরানোর সেই সিদ্ধান্তকে সবচেয়ে ‘বেদনাদায়ক ও কঠিন’ গুলোর একটি বলে মন্তব্য করেছিলেন মুন। কিন্তু এক্ষেত্রে অটল থাকলে অর্থায়ন বন্ধের কারণে ফিলিস্তিনি, সাউথ সুদান ও সিরিয়ায় আরও লাখ লাখ শিশুকে দুর্ভগে পড়ার হুমকির মধ্যে পড়তে হতো বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
মধ্য আগস্টে ফাঁস হয়ে যাওয়া এক প্রতিবেদনে সৌদি ইউএন মিশন দাবি করেছিলো, সৌদিকে এই প্রতিবেদনে যুক্ত করার কোন যৌক্তিকতা নেই। জাতিসংঘ এই বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে বলে নিজেদের বিশ্বাসের কথাও জানিয়েছিলো তারা।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রতিবেদন উপস্থাপনকে সামনে রেখে আবারও যেনো সৌদি জোটকে এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া না হয় সে ব্যপারে সোচ্চার হয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলি।
ইয়েমেনে নিয়োজিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক এনজিও সেভ দ্য চিলড্রেন এর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ক্যারোলিন এ্যানিং আল জাজিরাকে জানান, মারাত্মক অধিকার লঙ্ঘনের স্পষ্ট নির্দেশক থাকার পরও জোটকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হলে ইয়েমেনে এবং বিশ্বে শিশু অধিকার রক্ষায় কাজ করা গ্রুপগুলো অত্যন্ত হতাশ হবে।
“ইয়েমেনের সকল পক্ষই শিশুদের রক্ষায় গুরুতর অবহেলা করেছে। যুদ্ধের সরাসরি ফল হিসেবে কলেরার মহামারি, খাদ্য সংকটের মতো বিশ্বের জঘন্যতম মানবিক সঙ্কটগুলো আমরা দেখেছি।”
স্যাম অর্গানাইজেশন ফর রাইটস এন্ড লিবার্টিস এর নির্বাহী পরিচালক নাবিল আলবায়দানিও মনে করেন সৌদি জোট তাদের নাম প্রত্যাহার করে নিতে চাপ প্রয়োগ করবে। কিন্তু এবার তারা সফল হবে না বলেই তার প্রত্যাশা। অন্যথায় জাতিসংঘের প্রতি কারও বিশ্বাস থাকবে না বলেও তার অভিমত। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক এনজিও ওয়ার চাইল্ড-ও একই ধরণের বিবৃতি দিয়েছে। শিশুদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে অবশ্যই সৌদি জোটকে তালিকায় রাখতে হবে মন্তব্য করে তারা। অন্যথায় জাতিসংঘকে উপহাসের পাত্র হয়ে উঠবে বলেও অভিমত তাদের।
রবিবার কুয়েতে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব এ্যান্তোনিয়ো গুতেরেস বলেন, জোটকে তালিকা থেকে প্রত্যাহারের জন্য তাদের উপর কোন চাপ নেই। সঠিক সিদ্ধান্তই নেয়া হবে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক আল জাজিরাকে জানায়, জাতিসংঘ প্রধান এবং তার অফিস সকল পার্টির সাথেই যোগাযোগ রাখছে এবং তিনি যেটা সঠিক মনে করবেন সেই সিদ্ধান্তই নিবেন।
স্টিফেন দুজারিক আরও যোগ করেন যে, প্রতিবেদনটি বৃহস্পতিবার নিরাপত্তা পরিষদে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং শুক্রবারই তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হতে পারে।
ফাঁস হওয়া এই প্রতিবেদন ইয়েমেনে শিশুদের হত্যা ও আহত করার ১ হাজার ৩৪০টি ঘটনা যাচাই করা হয়, যার মধ্যে ৬৮৩টির (৫১ শতাংশ) ক্ষেত্রে দায়ী সৌদি জোটের বিমাল হামলা। ৪১৪ জন শিশুকে হত্যা বা আহত করার দায়ে হাউদি বিদ্রোহীদেরও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। হামলার শিকার হওয়া ছাড়াও অপহরণ, যুদ্ধে নিয়োজিত করা এবং যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় শিশুদের।
প্রতিবেদন অনুযায়ী সকল পক্ষের হামলায় সব মিলিয়ে ৫০২ জন শিশু নিহত এবং ৮৩৮ জন আহত হন। স্কুলগুলোতে বিমান হামলাগুলোর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বলেও উল্লেখ করা হয়।
এছাড়াও এই তালিকায় ইয়েমেনে যুদ্ধরত অন্যান্য পক্ষের মধ্যে রয়েছে আল-কায়েদা, কথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস), সরকারি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা।
জাতিসংঘ ইয়েমেনের এই পরিস্থিতিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট বলে অভিহিত করেছেন। দেশটির ১ কোটি ৮৮ লাখ মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন এবং কমপক্ষে ১ কোটি ৩ লাখ মানুষের জরুরিভিত্তিতে সহায়তা প্রয়োজন।
এছাড়াও ইয়েমেনে ১ কোটি ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ খাদ্য ঘাটতির মুখে রয়েছে। দেশটি দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বলেও সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। দেশটির ৮০ শতাংশ শিশুর জরুরিভিত্তিতে সহায়তা প্রয়োজন বলেও জানানো হয়।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে দেশটিতে রক্তাক্ত সংঘাত চলছে। হাউদি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানা দখল করে প্রেসিডেন্ট আব্দ-রাব্বু মানসুর হাদির সরকারকে উৎখাত করার পর থেকেই সংঘাতের সূচনা। ২০১৫ সালে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট হাউদিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। হাউদি বিদ্রোহীরা সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহের অনুগত।
যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১০ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন