নাফ নদীর ওপারে আরাকানের মংডু টাউনশিপের পৌরসভার আবাসিক এলাকার মুসলমানদের পাঁচটি মহল্লায় বৃহস্পতিবার রাতে অগ্নিসংযোগ করে মিয়ানমারের সেনারা। এতে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তিন শতাধিক বাসাবাড়ি। হতাহতের ঘটনা ঘটেছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের বাহিনীর নৃশংসতা শুরু হওয়ার পর এসব মহল্লার বেশির ভাগ রোহিঙ্গা মুসলিম প্রাণ বাঁচাতে আগেভাগে বাংলাদেশে চলে আসেন। আর যারা নিজেদের সহায়-সম্পদ ও ব্যবসাবাণিজ্য রক্ষার জন্য থেকে যান, শেষ পর্যন্ত তারাও আর থাকতে পারলেন না।
ওপারের সীমান্তের ব্যবসায়ীদের একটি সূত্র জানিয়েছে, মংডু টাউনশিপের পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডের সিনেমা হলের পূর্ব পাশের মুসলিম মহল্লায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরপরই সেনাসদস্যরা অগ্নিসংযোগ করে। এরপর তারা নয়াপাড়া, পূর্ব পাড়া, পশ্চিম পাড়া ও সুন্দরী পাড়ায় আগুন দেয়।
আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৯টার দিকে মাঙ্গালা পাড়ায় আগুন দেয় সেনাসদস্যরা। এ সময় শতাধিক রাখাইন মুসলিমবিরোধী স্লোগান দিয়ে রোহিঙ্গাদের ধাওয়া করে। শহরে অগ্নিসংযোগ করলেও দমকল বাহিনী ও পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়নি। রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত মংডু অঞ্চলের ৯০ ভাগ গ্রাম রোহিঙ্গা শূন্য হয়ে পড়েছে। এসব গ্রামের ৭০ ভাগ বসতি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে স্থানীয় রাখাইন ও সেনারা। রোহিঙ্গাদের ফেলে যাওয়া কিছু উন্নতমানের দ্বিতল কাঠের বাড়ি অক্ষত রাখা হয়েছে। সেসব দখলে নিচ্ছে স্থানীয় রাখাইনরা। এ দিকে নাফ নদীর উপকূলে এখনো হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছেন। যারা মাথাপিছু হাজার টাকা নৌকাভাড়া দিতে সক্ষম, শুধু তারাই পালিয়ে আসতে পারছেন। অন্যরা খেয়ে না খেয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে শুক্রবার ও বৃহস্পতিবার দুই দিনে আট হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নাফ নদী ও সাগরপথে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, আরকানের রোহিঙ্গা বসতিগুলো এখন জনশূন্য হয়ে ভুতুড়ে রূপ নিয়েছে। রোহিঙ্গা বসতিগুলোতে রাখাইন সন্ত্রাসীরা মুসলিম মুক্ত এলাকা উল্লেখ করে লাল পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে।
একদিকে সম্প্রতি মিয়ানমারের মন্ত্রী টিন্ট সোয়ে ঢাকায় সফরকালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে গেছেন, অন্য দিকে রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগে বাধ্য করার জন্য সেনাবাহিনী অভিযান জোরদার করছে। ফলে এখনো আরাকানে থাকা প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা এখন মহাবিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন। ফলে নতুন করে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছেন। এ কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদিও ইতোপূর্বে জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে এ সংখ্যা ১০ লাখ হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল।
গত ২৫ আগস্ট থেকে আরাকানে সেনাদের গণহত্যায় প্রাণ হারিয়েছেন ১০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা। সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশকালে নৌকাডুবিতে ও স্থলমাইন বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন আরো দেড় শতাধিক। বর্তমানে গণবিতাড়নের ফলে অবশিষ্ট রোহিঙ্গার সকলেই এখন বাংলাদেশমুখী হতে বাধ্য হচ্ছেন। বাংলাদেশ সীমান্তও খোলা রাখা হয়েছে। এতে প্রতি রাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা আসছেন বাংলাদেশে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সে দেশে একজন রোহিঙ্গাকেও থাকতে দেয়া হবে না।
ক্যাম্পগুলোতে ২১ দফা সংবলিত সাইনবোর্ড
নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার দাবি জানিয়ে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ক্যাম্পে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়েছে। ‘রোহিঙ্গা অধিকার প্রতিষ্ঠা কমিটি’ নামে একটি সংগঠন ২১ দফা দাবি দিয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে বিভিন্ন পয়েন্টে। বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ ও জন্মভূমি ছেড়ে পরদেশে সাহায্যনির্ভর মানবেতর জীবনযাপন করার চেয়ে নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে আকুতি জানিয়েছেন তারা।
উখিয়া উপজেলার কুতুপালং, বালুখালী, জামতলী, থাইনখালী ও টেকনাফ উপজেলার লেদা শরণার্থী শিবিরের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপিত শতাধিক এরকম পিভিসি সাইনবোর্ডে বিশ্ব সম্প্রদায় ও মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাংলা ও ইংরেজিতে উল্লেখ করা হয়েছে ২১ দফা দাবি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন