গরু জবাই নিষিদ্ধ করে গরু রক্ষা করতে গিয়ে এখন বড় ধরনের বিপদে পড়েছে ভারত সরকা্র। ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারে আসার পর গরু রক্ষার যে তৎপরতা শুরু হয়েছে, তার বিপদ নিয়ে এবার সতর্কবার্তা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সমীক্ষা প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা বলছে, গবাদি পশু জবাইয়ে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা টানা হলে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকরাই। এত দিন কৃষক সংগঠনগুলো এই আশঙ্কার কথা জানিয়ে আসছিল, তাতে সায় দিচ্ছিলেন অর্থনীতিবিদরাও।
রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য গরুরক্ষার নামে সারা ভারতে মুসলিম বিদ্বেষি রাজনীতি শুরু করেছে ভারত। দেশটি বিভিন্ন প্রদেশে গরুর মাংস রাখার কারনে হত্যা করা হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গো-মাংস নিয়ে ‘বাড়াবাড়ি’ শুরু হয়। গরু জবাইকে কেন্দ্র করে একের পর এক পিটিয়ে খুনের খবর আসে গণমাধ্যমে।
আপত্তি উপেক্ষা করেই হাট-বাজারে গবাদি পশুই জবাইয়ের উদ্দেশ্যে কেনাবেচা করা যাবে না বলে নিয়ম জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার।
আর্থিক সমীক্ষা প্রতিবেদনের কোথাও সরাসরি গবাদি পশু জবাইয়ে নিষেধাজ্ঞা বা গোরক্ষক বাহিনীর উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু বলা হয়েছে, কর্মক্ষমতা হারানোর পরে গবাদি পশুর দামের উপরেও পশুপালকদের রুটিরুজি নির্ভর করে। এমনিতেই কৃষি থেকে আয় পড়তির দিকে। কোনো ‘সামাজিক নীতি’র জেরে পশুর মাংস বেচে আয় বন্ধ হলে এবং বুড়িয়ে যাওয়া গবাদি পশুকে বসিয়ে খাওয়াতে হলে চাষি-পশুপালকদের আয় আরও কমবে। এই সব ‘সামাজিক নীতি’র ফলে সমাজে ক্ষতিই হবে।
আর্থিক সমীক্ষা তৈরি করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি তা পার্লামেন্টে উপস্থাপন করেন।
মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এই ‘সামাজিক নীতি’ কি গবাদি পশু জবাইয়ে নিষেধাজ্ঞা? তার জবাব ছিল, “এই সব প্রশ্ন করে আমাকে বিপদে ফেলবেন না।”
বাম দল সিপিএমের কৃষক সভার নেতা হান্নান মোল্লা বিজেপির নীতির সমালোচনা করে বলেন, “কৃষকদের আয়ের ৭০ ভাগ আসে জমি থেকে। বাকিটা পশুপালন থেকে। চাষের ক্ষতি সামলাতে না পেরে কৃষকরা আত্মহত্যা করছেন। দুধ দেওয়া বা মাঠে হাল টানা বন্ধ করার গরু-মোষ পুষতে হলে তার খাইখরচ কোথা থেকে আসবে?”
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক বিকাশ রাওয়াল এই প্রসঙ্গে বলেন, “বছরে ৩ কোটি ৭০ লাখ পুরুষ গরু-মোষ জন্ম হয়। জবাই বন্ধ হলে এদের খাবারের পেছনে বছরে ৫.৪ লক্ষ কোটি টাকা খরচ। “এই আর্থিক দায়ভার কি সরকার বইতে রাজি?”
এক এনজিও-র জনমত সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৯৭ শতাংশ গণপিটুনি এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে মোদী ক্ষমতায় আসার পর৷ উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ডে গোরক্ষার নামে চলেছে একের পর এক হামলা এবং মানুষ খুন৷
বিরোধীদের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী গোরক্ষকদের বিরুদ্ধে কথা বললেও তাঁর সরকার প্রকারান্তরে গো-রক্ষক বাহিনীকেই প্রশ্রয় দিচ্ছে৷ হরিয়ানার বল্লভগড়ের কাছে ট্রেনে জুনেইদ খান নামে ১৫ বছরের এক মুসলিম কিশোরকে হত্যা করা হয়৷ একদল দুষ্কৃতি গোমাংস খাওয়া এবং গোহত্যা নিয়ে তর্কের জেরে জুনেইদকে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে৷ ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকেই এই হত্যা বলে সন্দেহ৷ পুলিশ অবশ্য পরে হত্যাকারীকে মহারাষ্ট্র থেকে গ্রেপ্তার করে৷ কিন্তু এখানেই শেষ নয়৷ দিল্লিতে লরিতে করে গরু নিয়ে যাওয়ার সময় সাতজন শ্রমিক গোরক্ষকদের হাতে গণপিটুনির শিকার হয়৷ কয়েকজনের আঘাত গুরুতর৷
গত ২৯শে জুন ঝাড়খণ্ডের রাঁচির কাছে আলিমুদ্দিন আনসারি নামে একজন গরু ব্যবসায়ী গণপিটুনিতে প্রাণ হারান৷ ঐ মাসেই এক ডেয়ারি মালিকের ওপর শ-খানেক লোক চড়াও হয়৷ মারধর করে এবং তাঁর ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়৷ কারণ? তাঁর ঘরের কাছে পড়েছিল একটা মরা গরু৷
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরে গত ২৪শে জুন তিনজন নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে খুন করা হয়৷ অভিযোগ তাঁরা নাকি গরু চুরি করে পাচার করছিল৷ এপ্রিল মাসে আসামে আবু হানিফা এবং রিজাউদ্দিন আলি গণপিটুনিতে মারা যায়৷ সন্দেহ, তাঁরা নাকি গরু চুরি ও পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিল৷ পুলিশ অবশ্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করে৷
একই ধরনের ঘটনা ঘটে রাজস্থানের আলওয়ারে৷ ৫৫ বছর বয়সি পেহলু খানকে গরু পাচারকারী সন্দেহে এমনভাবে মারধর করা হয় যে, দু'দিন পর হাসপাতালে মারা যায় সে৷ হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন হত্যাকারীকে বাহাবা দিয়েছে বলে শোনা গেছে৷ এহ বাহ্য, মোদীর রাজ্য গুজরাটের উনা শহরের দিকে যাওয়ার রাস্তার পাশে এক দলিত পরিবারকে মরা গরুর চামড়া ছাড়াতে দেখে সেই ছবি কেউ পোস্ট করলে তা ভাইরাল হয়৷ গৌ-রক্ষকদের দল সেখানে পৌঁছে তাঁদের বেধড়ক পেটায়৷ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় দলিত সমাজে৷
২০১৭ সালের প্রথম ছ'মাসে গোরক্ষকদের হাতে প্রাণ হারায় ২২ জন৷ এই ঘটনা ক্রমশই বেড়ে চলেছে৷ থামার লক্ষণ নেই৷ দেশের সুশীল সমাজ অভিযোগের আঙুল তুলেছে মোদীর গৈরিক সরকারের দিকে৷ বলেছে, গোরক্ষার নামে হামলার পেছনে সরকারি প্রশ্রয় রয়েছে৷ অথচ সুপ্রিম কোর্ট হালে জবাইয়ের জন্য গরু-মোষ কেনাবেচা নিষিদ্ধ করার সরকারি নির্দেশের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন৷
দ্বিতীয়ত মোদী সরকারকে এটা বুঝতে হবে যে, গোমাংস ও চামড়ার ব্যবসা মুসলিম ও দলিত সম্প্রদায়ের পেশা বা জীবিকা৷ সেটা বন্ধ করা অযৌক্তিক৷ এর অভিঘাত দেশের অর্থনীতির ওপরও পড়বে৷ এই নিয়ে মুক্তমনা বুদ্ধিজীবীরা আওয়াজ তুললে সনাতন সংস্থা, বজরং দল, রাম সেনা, দুর্গা বাহিনী, হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির মতো হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলি তাঁদের হত্যার হুমকি দেয়৷
এটাকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে বিচার করলেন ইন্ডিয়ান ইন্সিটিটিউট অফ সোশ্যাল স্টাডিজের অধ্যাপক বুদ্ধদেব ঘোষ৷ ডয়চে ভেলে তিনি বললেন, ‘‘সন্দেহ নেই যে এর পেছনে সরকারের প্রশ্রয় আছে৷ তবে এ কথা ঠিক অনেক জায়গায় গরু জবাই করা হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে৷ তাই সেটার সংস্কার দরকার৷ কিন্তু মাংস খেতে দেবো না, বিক্রি করতে পারবে না – এটা কেমন কথা?’’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন