মিয়ানমারে এখন চলছে রোহিঙ্গাদের ঘরবন্দি জীবন। ঘর থেকে বেরোলেই গুলি। মিয়ানমার সেনাবাহিনী চায়, রোহিঙ্গারা ঘরে বন্দি থেকে ভাত-পানির অভাবে মরুক, অথবা পালাক বাংলাদেশে।
আর এই জীবন থেকে মুক্তি পেতে আবার বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নেমেছে। নতুন ঢলে ভেসে এসেছেন রাখাইনের বুচিডং এলাকার মৌলভি জমির উদ্দিন। বৃহস্পতিবার সকালে পৌঁছেছেন উখিয়ার বালুখালীতে। এখনো কোনো ক্যাম্পে স্থান হয়নি তার।
তার সঙ্গে কথা হয় রাস্তার ধারে আশ্রয় নেয়ার মুখেই। মৌলভি জমির বলেন, ‘দেশের মায়া সবার আছে। আর আমরা সেই দেশের খুবই সচ্ছল পরিবারের মানুষ। টাকা-পয়সা, ধনদৌলত সবই আছে। তাই যেভাবে পারছি এত দিন ম্যানেজ করে ছিলাম। কিন্তু বর্তমানে ভাতে, পানিতে মারছে মিয়ানমার সেনা ও উগ্র রাখাইনরা। ঘর থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বের হলেই গুলি। তাই জীবনের মায়া ছাড়তে না পেরে বাঁচার তাগিদে পালিয়ে এসেছি এদেশে।’
এ রকম আরো বহু আশ্রিতের দেখা মিলবে সীমান্ত এলাকার নানান রাস্তায়, যারা সদ্যই পালিয়ে এসছেন মিয়ানমার থেকে।
গত বৃহস্পতিবার সকালে ধামনখালী সীমান্তে আশ্রয় নেয়া মো. আবুল কাশেম বলেন, ‘বর্তমানে যারা মিয়ানমারের বুচিডং ও রাচিডং থানা এলাকাসহ আশপাশ এলাকায় রয়েছে, তাদের ঘর থেকে বের হয়ে পানি খাওয়ারও সুযোগ নেই। কারণ দেখলেই গুলি। অনাহারে অর্ধহারে প্রতিনিয়িত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে শত শত রোহিঙ্গা শিশু। মারা যাচ্ছে তাদের বাবা-মা। ’
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানালেন, বুচিডং ও রাচিডং থানার সব গ্রাম এখন রোহিঙ্গাশূন্য।
এদিকে বাংলাদেশের উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় খাদ্যের অভাবে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন তারা। কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মনজুরুল হাসান খান বলেন, ‘আমাদের হিসাবমতে গত ৩/৪ দিনে ১১ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। তবে সাধারণ লোকজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, গত এক সপ্তাহে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে।’
এদিকে স্থলসীমান্তে মাইন বিস্ফোরণের আতঙ্কে বর্তমানে সাগরপথে নাফ নদী হয়ে পালিয়ে আসছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। বৃহস্পতিবার ও বুধবার সকালে এবং মঙ্গলবার ভোর সকালে আঞ্জুমান পাড়া, রহমতের বিল ও ধামনখালী সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেখা গেছে।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামায় স্থানীয় লোকজনের মাঝে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। মিয়ানমারের বুচিডং থানার সাঙ্গমা, ঝুপাড়া গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা ৪৫ বছর বয়সি রোকসানা বেগম বলেন, ‘সেনা ও রাখাইনদের অত্যাচারে জান বাঁচাতে আমরা দুই গ্রাম থেকে ১৫-১৬ হাজার মানুষ একসাথে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার জন্য বের হই। বুচিডং থেকে পায়ে হেঁটে গভীর জঙ্গল পেরিয়ে আসতে অনেক লোক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ সময় অন্তত ২০-২৫ জনের মৃত্যু হয়। তবে যে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি চোখের সামনে মানুষ মরে গেলেও চোখ দিয়ে পানি আসে না। যারা বেঁচে ছিল তাদের অবস্থা ক্ষুধা তৃষ্ণায় এমন ছিল যে কারো মৃত্যুশোকে চোখের পানিও বের হবার মতন শক্তি অবশিষ্ট ছিলো না।’
সূত্র জানায়, মিয়ানমারের সর্বশেষ আদম শুমারি অনুযায়ী রাখাইনে প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস ছিল। সেখান থেকে রাখাইনের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে এক লক্ষ ৬০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। গত বছরের অক্টোবরের সহিংসতার পর রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। গত ২৫ আগষ্টে ঘটনার পর গত বুধবার পর্যন্ত রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত ৬ লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে ৮ লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা আরাকান থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে বলে জানা গেছে।
অবশিষ্ট প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে পঞ্চাশ হাজার সেখানকার বিভিন্ন জেলে আটকা রয়েছেন। বাকিরাও যে যেভাবে পারছে প্রতিদিন সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে।
এদিকে উখিয়া ও টেকনাফের সাধারণ লোকজন আশঙ্কা প্রকাশ করেন, রোহিঙ্গাদের অতীতের আশ্রয়দানের অভিজ্ঞতা তেমন ভালো নয়। যেভাবে আরো ব্যাপক আকারে রোহিঙ্গা প্রবেশের ঘটনা ঘটছে, ভবিষ্যতে এটি বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত না হয়ে দাঁড়ায়।
এ বিষয় নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘গত দুই দিনে পালংখালী সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ২৫ হাজারের বেশী রোহিঙ্গা অনুপ্রবশ করেছে। অতিরিক্ত রোহিঙ্গার চাপে এখানকার জন পদে সর্বত্র লোকজনের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে।’
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন