ডিকাব টকে বক্তব্য দিচ্ছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত রেঞ্জে তেয়ারিঙ্ক।ডিকাব টকে বক্তব্য দিচ্ছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত রেঞ্জে তেয়ারিঙ্ক।
চীন ও রাশিয়ার ভূমিকার কারণে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে উল্লেখ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত রেঞ্জে তেয়ারিঙ্ক বলেছেন, এই ভূমিকা জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়েছে। এ জন্য আমরা রাখাইন সঙ্কট নিরসনে নিরাপত্তা পরিষদে অনেক প্রস্তাবই পাস করতে পারিনি। এর সাথে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যেগে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এসব কারণে মিয়ানমারে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ও জাতিগত নির্মূল অভিযান চলার পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমন্বিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দ্বিধাগ্রস্থ।
তিনি বলেন, চীন, রাশিয়া ও ভারতকে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে জোরালো প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মনোযোগে রাখাইন পরিস্থিতিকে অব্যাহতভাবে ধরে রাখতে হবে। বিভিন্ন দেশের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দসহ জাতিসঙ্ঘ সংস্থাগুলোর প্রধানদের কক্সবাজার সফর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিকে এই সমস্যার প্রতি কেন্দ্রীভূত রাখতে সহায়ক হচ্ছে।
বাংলাদেশ কূটনৈতিক সংবাদদাতা সমিতির (ডিকাব) সাথে মতবিনিময়ে ইইউ রাষ্ট্রদূত একথা বলেছেন।
আজ রাজধানীর লেক শোর হোটেলে ‘ডিকাব টক’ নামে পরিচিত এই মতবিনিময়ের আয়োজন করা হয়।
ডিকাব সভাপতি রেজাউল করিম লোটাসের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পান্থ রহমান।
তেয়ারিঙ্ক গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতির কাছে পরিচয়পত্র পেশ করেছেন।
লুক্সেমবার্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানসহ সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ইউরোপে আমন্ত্রণ না জানানো এবং দেশটির ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ ছাড়া মিয়ানমারকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ থেকে বিরত রাখা যাবে বলে মনে করেন কি না - প্রশ্ন করা হলে রাষ্ট্রদূত বলেন, মিয়ানমারে যা ঘটছে সেটা সম্পর্কে এটা ইইউ’র সমন্বিত প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ইউরোপে আমন্ত্রণ না জানানো পদক্ষেপটা প্রতীকি হলেও গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাংলাদেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতির অভাব আমাদের চোখে পরছে। রাখাইন সঙ্কট নিরসনে আমরা কফি আনান কমিশন প্রতিবেদনের বাস্তবায়ন চেয়েছি। যদি এসব ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি না হয়, তবে ইইউ মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগে আরো পদক্ষেপ নেবে।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক অবরোধ হচ্ছে কোনো দেশের ওপর চাপ প্রয়োগের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। তার আগে আমাদের হাতে থাকা অন্যান্য অস্ত্রগুলোর কার্যকারীতা যাচাই করে দেখতে চাই। কেননা মিয়ানমারকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের জন্য আমাদের অনেক বিনিয়োগ করতে হয়েছে। আগামী ২০ ও ২১ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে অনুষ্ঠেয় আসেম সম্মেলনে রাখাইন সঙ্কট নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ইইউ ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর পরিকল্পনা করেছে।
তেয়ারিঙ্ক বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সব ধরনে সহায়তা দেবে ইইউ। এতো অল্প সময়ের মধ্যে এতো বিপুল সংখ্যাক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। ইইউ’র মানবিক ত্রাণ বিষয়ক কমিশনার আগামী ৩০ অক্টোবর বাংলাদেশে আসছেন। কমিশনার ত্রাণ সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনার পাশাপাশি কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিন পরিদর্শন করবেন। আগামী ২৩ অক্টোবর জেনেভাতে জাতিসঙ্ঘ সংস্থাগুলোর সাথে ইইউ যৌথভাবে দাতা সম্মেলনের আয়োজন করেছে, যেখান থেকে প্রতিশ্রুত অর্থ রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যবহার করা হবে।
জাতিসঙ্ঘের সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাচ্ছে না - এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তেয়ারিঙ্ক বলেন, রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জাতিসঙ্ঘ ৪৩৪ মিলিয়ন ডলার তহবিলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করেছে। জেনেভায় অনুষ্ঠেয় দাতা সম্মেলনের মাধ্যমে এ অর্থের প্রতিশ্রুতি পাওয়ার চেষ্টা করা হবে। এ অর্থ দিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চাহিদা মেটানোর সম্ভব হবে। কিন্তু তার পর কি হবে - সেটা নিয়েও আমাদের চিন্তা করতে হবে। রোহিঙ্গারা যে খুব শিগগির মিয়ানমার ফেরত যেতে পারবে - দুর্ভাগ্যজনক হলেও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এমনটাও মনে হচ্ছে না। এখন আমরা দেখি দাতা সম্মেলনে কি হয়।
সূচনা বক্তব্যে রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের সাথে অংশীদারিত্ব ইইউ’র জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার মেয়াদকালে বাংলাদেশের সাথে বহুমুখী সম্পর্ক আরো জোরদার করা ইচ্ছা রয়েছে। তিনি বলেন, ইইউ বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাজার। বাংলাদেশের পণ্য ইইউ’র বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প ও ইউরোপের ক্রেতা কোম্পানিগুলো এটা থেকে লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে সাসটেইনিবিলিটি কম্পেট ভূমিকা রেখে চলছে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, জাতিসঙ্ঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে ইইউ। এসব সহযোগিতার আওতায় রয়েছে শিক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রভৃতি। এটা ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে সহায়তা দেবে। এছাড়া সুশাসন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সামাজিক উন্নয়ন ইইউ-বাংলাদেশের সম্পর্কের মূলে রয়েছে।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত করছে উল্লেখ করে তেয়ারিঙ্ক বলেন, এ নির্বাচনে আমরা পর্যবেক্ষক পাঠাতে চাই। তবে এজন্য নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণ আমাদের প্রয়োজন হবে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ইস্যুতে ইইউ ও বাংলাদেশের অভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বহু ইস্যু রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা। এ পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে আমরা বাংলাদেশকে সহযোগিতা দিয়ে যেতে চাই। এছাড়া কার্বন নির্গমন কমাতে ইইউ তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করে যাবে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা বাড়াতে কানেক্টিভিটির গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, এক্ষেত্রে বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল) কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন