ওপারে আমাদের ওপর মিয়ানমার সেনা ও মগরা খুবই অত্যাচার চালাচ্ছে। আমাদের কাউকে ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না, দোকানপাটও বন্ধ রাখা হয়েছে। সেখানে চরম খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া তারা আমাদের যুবতী মেয়েদের জুলুম (ধর্ষণ) করবে বলেও প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য মগের মুল্লুকে থাকার চেয়ে মুসলমানের দেশে মরা অনেক ভালো। এভাবেই রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনা ও মগ সম্প্রদায়ের অমানবিক নিপীড়ন-নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন রাখাইনের বুচিডং গোদামপাড়া থেকে টেকনাফে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা খুরশিদা বেগম। তিনি গত ১৫ অক্টোবর রাতে নৌকায় নাফ নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়াদের একজন। শাহপরীর দ্বীপ সৈকতে গত মঙ্গলবার বিকালে তিনি নিখোঁজ স্বজনদের লাশ খুঁজে ফিরছিলেন। এ সময় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে তার কথা হয়।
খুরশিদা জানান, ওই দিন রাতে রাখাইনের ঢংখালী সীমান্ত থেকে তারা অন্তত ৬০ জনের একদল রোহিঙ্গা নৌকায় চেপে বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ করতে যাচ্ছিলেন। শাহপরীর দ্বীপের অদূরে বঙ্গোপসাগরে ঢেউয়ের আছড়ে তাদের বহনকারী নৌকাটি ডুবে যায়। এ দুর্ঘটনার পর ১২ জনের মৃতদেহ ও ২২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও বাকিদের এখনো হদিস মেলেনি।
খুরশিদা বেগমের কান্নাজড়িত বর্ণনানুযায়ী, তারা এসেছেন বুচিডং গোদামপাড়া থেকে। নৌকার অভাবে প্রায় ১৫ দিন ঢংখালী সীমান্তে অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতন দিন কাটিয়েছেন। তার পরিবাবের ৬ সন্তানসহ ৮ জন ওই নৌকায় উঠেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কূলে ভিড়তেই হঠাৎ নৌকাটি ডুবে যায়। এতে স্বামী-স্ত্রী দুজন প্রাণে বেঁচে গেলেও ৬ সন্তানই মারা যায়। পাঁচ সন্তানের লাশ পেয়েছেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত ছোট মেয়েটির সন্ধান পাননি।
শুধু খুরশিদা নন, রোহিঙ্গাবাহী নৌকাডুবিতে নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে শাহপরীর দ্বীপ সৈকতে দিগি¦দিক ছোটাছুটি করছিলেন বুচিডং এলাকার মো. রফিক ও তার বড় ছেলে জিয়াউর রহমান। রফিক জানান, নৌকার মাঝি অতিরিক্ত লোক নিয়েছিল। সে কারণেই নৌকা ডুবেছে। কয়েকটি পরিবার এখনো ২৫ জনের খোঁজ পায়নি। নিখোঁজদের মধ্যে রফিকের স্ত্রী ও এক কন্যা রয়েছে।
টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাঈন উদ্দীন খান জানান, রোহিঙ্গাবাহী নৌকাডুবিতে নিখোঁজদের মৃতদেহ পাওয়া গেলে তাদের স্বজনদের খবর দেওয়া হবে, যাতে তারা লাশ শনাক্তের মাধ্যমে অন্তত কিছুটা সান্ত¦না পেতে পারে।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা শুরুর পর থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশ অভিমুখে নেমেছিল রোহিঙ্গাদের ঢল। তাদের বেশিরভাগই নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে নৌকায় চেপে উত্তাল নদী-সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ২৮টি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১৭৩ জন রোহিঙ্গার মৃতদেহ পাওয়া গেলেও নিখোঁজের সঠিক তথ্য কেউ জানাতে পারেনি। তবে নৌকাডুবিতে প্রাণে রক্ষা পাওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে শিশু ও নারীর। প্রিয়জনকে হারিয়ে বা খোঁজ না পেয়ে আশ্রয় শিবিরে শোকে বিহ্বল দিন কাটাচ্ছেন বহু রোহিঙ্গা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন