১২ই সেপ্টেম্বর রাতে চেংশুই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে আমরা পৌঁছি ইউনিভার্সিটি টাউন এলাকায়। বেশির ভাগ রাস্তা গাড়িশূন্য মনে হয়েছে। দূরে মাঝেমধ্যে সাবওয়ে ট্রেন চলে যাচ্ছে চোখে পড়েছে। ট্রাফিক ডিজিটাল সিগন্যাল অনুসরণ করে দু’চারবার থেমেছে এই যা। কিন্তু কোথাও গাড়ি আটকে আছে এমনটা দেখা যায়নি। যদিও প্রথমদিনই সবটুকু ঠাহর করা সম্ভব হয়নি।
পরদিন প্রতিটি যাত্রাপথ ভালো করে খেয়াল করেছি। তা কুনমিং কেন্দ্রস্থল থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে স্টোন ফরেস্ট এলাকায় যেদিন গেলাম তা থেকে শুরু করে ৩০০ কিলোমিটার দূরবর্তী ত্বালি শহর পর্যন্ত। কোথাও একটি ছিটেফোঁটা ট্রাফিকও পাইনি। ত্বালি ভ্রমণে এই তিনশ’ কিলোমিটার পথ গাড়িটি একবারের জন্য হোঁচট খায়নি। রাস্তায় কোনো খানাখন্দ বা উঁচু-নিচু হয়েছে এমন মনে হয়নি। যখন বিমানে উঠি তখন বাতাসের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বাফারিং হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে এমন কোনো বিষয়ও ছিল না। আমাদের গাড়িটি চলার পুরো পথই ছিল পাহাড়ি। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়। যদিও পথ ছিল ওয়ানওয়ে। আমরা যে পথকে হাইওয়ে বলি- চীনারা এই পথগুলোকে বলে এক্সপ্রেসওয়ে। এক্সপ্রেসওয়েগুলোও যেন সাজানো-গোছানো। রাস্তায় বা টানেলে কোথাও টোলঘর মানুষ দেখেনি। সবই ডিজিটাল। কুনমিং টাউন ও ত্বালি যাওয়ার পথে যে সব রাস্তা চোখে পড়েছে তা হচ্ছে- চিথিয়ান, চিয়ামি, তুনান, ওয়াংচিয়াংইং, ফুহাই, ইলিউ, ছুচিন, অ্যানিং, মিনহ্যাং রোড, চিং লু, হ্যাংচাং তংলু, হ্যাংচাং প্লিইউ, ইউহুয়া চি, চাংখং, শিলিন জে। এইসব সড়কের বেশিরভাগই কখনো ট্রাফিক কি তা চোখে পড়েনি। কারণ সবই ডিজিটাল-ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে চলছে। ডাউন টাউনে অফিস চলাকালীন গাড়ির লাইন চোখে পড়েছে। তবে তা অনেক ফাঁকা ফাঁকা। এটি আমাদের নগরীর মতো চিত্র নয়।
চৌদ্দদিনের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে সাইকেল আর সাবওয়ে-এই দুই-ই এগিয়ে দিয়েছে চীনকে। বাঁচিয়ে দিয়েছে সময়। যানজট মুক্ত করেছে শহরকে। কুনমিং-এর বাইরে পেইচিং, কোয়াংচু ভ্রমণ করেছে এমন ক’জনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি প্রচুর সাবওয়ে আছে এইসব সিটিগুলোতে। খুব অল্প দূরত্বে দূরত্বে সাবওয়ে। সকলেই নির্ধারিত টিকিট নিয়ে গন্তব্যে ছুটছে। অফিস সময়ে এই সাবওয়েগুলোতে ভিড় হয় প্রচুর। আর নিকটবর্তী স্থানে সকলেই ব্যবহার করে সাইকেল। বলা হয়ে থাকে কুনমিং অনেকটাই অনুন্নত চীনের অন্যান্য শহরের তুলনায়। আর পাহাড় থাকায় উঁচু-নিচু বলে এখানে সর্বত্র সাবওয়ে সেবা এখনো পৌঁছাতে পারেনি সরকার। কিন্তু সেই কুনমিং-এও রয়েছে দু’তলা সাবওয়ে। চাংখং-এর সবচেয়ে ব্যস্ততম স্কয়ার তুংফং-এ দু’তলা সাবওয়ে রয়েছে। মানুষ ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যে ছুটছে এর মাধ্যমে।
চীনে ব্যক্তিগত গাড়ি আছে। তবে বেশিরভাগই নিজেরা চালান। কারণ, গাড়ির চালক রাখা অনেক বেশি ব্যয়বহুল। চালককে সরকারি আইন অনুযায়ী বেতন ও অন্যান্য সুবিধা দিতে হবে। আর আট ঘণ্টার অতিরিক্ত কাজ করালে বা গাড়ি চালালে চালককে দিতে হবে অতিরিক্ত ১০০ আরএমবি। যা প্রতি ঘণ্টায়। অর্থাৎ বাংলাদেশের হিসাবে প্রায় দেড় হাজার টাকার মতো। বলা হয়ে থাকে, চীনে এক বছরে চালকের পেছনে যে ব্যয় হয় তা দিয়ে নতুন একটি গাড়ি কিনে ফেলা যায়। আমাদের ইয়ুথ সামার ক্যাম্প সমন্বয়কারী লিও লাওশি কুনমিং শহরেই বাস করেন। নিজের গাড়িও রয়েছে। অতিরিক্ত ব্যয় চিন্তায় তিনি চালক রাখার চিন্তাও করতে পারেন না। গাড়ি পালাক্রমে তিনি ও তার স্ত্রী মিলে চালিয়ে থাকেন। আর ট্রাফিক পদ্ধতি সহনশীল ও নিয়মানুগ বলে নিজেদের গাড়ি চালানো কঠিন কাজ নয়। চীনে গাড়ি খুব সস্তা। কাজেই যে কেউ এক বছর/দুই বছর কাজ করে সঞ্চিত অর্থে গাড়ি কিনতে পারেন। এর জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণও মিলবে। কিন্তু চীনে নিজেদের গাড়ি না থাকলেও খুব একটা সমস্যা হয় না। শহরে বের হলেই পাওয়া যাচ্ছে সাইকেল বা চার্জার বাইক। যা নির্ধারিত হারে টাকা পরিশোধে ব্যবহার করা যায়। বর্তমানে প্রাইভেট কারও একই সুবিধায় পাওয়া যাচ্ছে। প্রয়োজনমাফিক যেকোনো মাধ্যম আপনি বেছে নিতে পারেন। কুনমিং-এ উবার চলে। তবে উবার খুব একটা জনপ্রিয় হতে পারেনি। চীনারা জাতিগতভাবে বাইরের কোনো কিছুকে সহজে গ্রহণ করতে পারে না। নিজেদের ওপর তারা এতটাই আস্থাশীল। যে কারণে উবার নয় সেখানে জনপ্রিয় মাধ্যম হচ্ছে তিথি।
তিথি অ্যাপস দিয়ে ডাকলেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে হাজির হবে। আর খুব সস্তায় আপনি যেখানে খুশি যেতে পারবেন। এর বাইরে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়েও মূল রাস্তায় বা শপিং মলে চালকরা অপেক্ষায় থাকে। দূরত্ব হিসেবে ভাড়া, কথা বলে উঠে পড়লেই হলো। তবে এই গাড়িগুলো সবই জিপিআরএস পদ্ধতিতে চলে।
চীনে ট্রাফিক আইন খুবই কড়াকড়ি। এক্সপ্রেসওয়েতে বা রিজার্ভ গাড়িতে কোনো যাত্রী দাঁড়িয়ে নেয়া যাবে না। সিটবেল্ট বাধ্যতামূলক। এমননি বাসের ভেতরের সিটেও বসে বেল্ট বাঁধতে হয়। আমরা যখনই বাইরে যেতাম আমাদের গাইড সিটবেল্ট বাঁধার জন্য অনুরোধ করতেন। আর কুনমিং থেকে ত্বালিতে যাওয়ার পথে যে সব স্থানে বিশ্রামের জন্য আমরা নেমেছি সেখানে একই সঙ্গে আমরা পুলিশ বক্স দেখেছি। যারা কোনো সন্দেহ বা অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। আর একটি লক্ষণীয় বিষয় যে, দিনের বেলায় না বুঝলেও রাতের বেলায় বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছি। তা হচ্ছে যখনই কোনো গাড়ি সিগন্যালের রেড মার্ক পার হচ্ছে তখন ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে ওঠছে। আর তা হচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমে এর ছবি পৌঁছে যাচ্ছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ বিভাগে। বাস বা প্রাইভেটকারে সামনের দিকে যারা বসেন আর যিনি গাড়ি চালান তার ছবি সংরক্ষণ করা হয় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। যদি কেউ আইন অমান্য করেন তা পরপর প্রতিটি ক্যামেরাতেই ধরা থাকে। ফলে আইন অমান্য করেনি এমন কোনো কৈফিয়ত দেয়ার সুযোগ নেই। চীনারা তথ্য-প্রমাণে বিশ্বাসী। কাজেই কেউ আইন ভঙ্গ করলে তা প্রমাণ রয়েছে ক্যামেরাতেই। অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি। সর্বোচ্চ শাস্তি লাইসেন্স বাতিল এমনকি গাড়ির রোড পারমিটও বাতিল করা হয়। ট্রাফিক আইনকানুন এতটাই কড়াকড়ি যেকোনোভাবে এর ব্যত্যয় ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি। যেমন, বাসে যদি ৪০ সিটের স্থলে ১ জন যাত্রীও দাঁড়িয়ে নেয়া হয় আর ক্যামেরায় তা ধরা পড়ে তবে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়। আর ছোট ছোট অপরাধ যুক্ত হয়ে রেটিংস কমে গেলে যদি লাল দাগ পড়ে তবে সেই চালকের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। আর একবার লাইসেন্স বাতিল হলে তা আর ফিরে পাওয়ার সুযোগ নেই।
সাইকেল যেভাবে এগিয়ে দিয়েছে
কুনমিং পৌঁছার দ্বিতীয় দিন থেকে চলার পথে খেয়াল করেছি পথে পথে সাইকেল। কিছুদূর পরপর মোড়ে সাইকেল ডিজিটাল পদ্ধতিতে রাখা। ইউনান ইউনিভার্সিটি টাউন হলের চারপাশে একাধিক সাইকেল স্ট্যান্ড চোখে পড়েছে। ক্লাস বা ওয়ার্কশপের ফাঁকে মনে হতো ছুটে যাই সাইকেল নিয়ে। কিন্তু সব সাইকেলগুলো একটি নির্দিষ্ট নিয়মে চলে। এগুলোর কোনোটিই ব্যক্তি মালিকানার নয়। নির্দিষ্ট কোম্পানি এই সাইকেলগুলো পরিচালনা করে। এর সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা তাদের নিজস্ব লোকবল দিয়ে চলে। আর কুনমিং শহরে বেশির ভাগ রাস্তাই ৪ থেকে ৮ লেনের। এর বাইরে সাইকেল বা বিদ্যুৎচালিত চার্জার বাইকের রয়েছে পৃথক লেন। এদের ফুটপাথগুলো বিশাল চওড়া। অনেক ফুটপাথে দেখেছি পৃথক সাইকেল লেন। এ চিত্র পুরো চীনেই। আর কুনমিং শহরে যে সাইকেল কোম্পানি সেই একই কোম্পানি পেইচিংসহ অন্যান্য শহরেও তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। আর মজার বিষয় হচ্ছে রাস্তার এই পৃথক সাইকেল লেনে বড় করে সাইকেলের ছবি আঁকা আছে। যেন সাইকেল তার চলার পথ পায়। আর অন্য গাড়ি না প্রবেশ করে। আর আমরা দুনিয়াজুড়ে চীন-জাপানের ইয়ামাহা বা মারুতি সুজুকির মোটরবাইক ডিজেল বা পেট্রোল চালিত দেখি তা কিন্তু চীনে নেই। তাদের সবই চার্জার বাইক। আর নতুন একটি চার্জার বাইক কিনতে খরচ পড়ে মাত্র আড়াই হাজার আরএমবি। বাংলাদেশের হিসাবে প্রায় ত্রিশ/বত্রিশ হাজারের মতো। আর পুরো বছর চার্জ দিতে খরচ পড়ে ৪০ আরএমবি। যেখানেই মন চায় ছুটছে সবাই চার্জার বাইক নিয়ে। কুনমিং শহরেই বাংলাদেশের বেশ ক’জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়েছে যারা চার্জার বাইক নিয়ে চলাফেরা করেন। এতে তাদের যাতায়াত ব্যয় একেবারেই কমে যায়। আর এই সাইকেল আর চার্জার বাইক থাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি মালিকরা সাধারণত গাড়ি বাইরে বের করেন না। কারণ চালানোর যে ধরনের চাপ তা সাইকেলে নেই। সাইকেলের দায়িত্ব কোম্পানির। উইচাটে হিসাব খুললেই- আপনি পেয়ে যাচ্ছেন সাইকেল। ঘণ্টায় ব্যয় হয় এক আরএমবি। আর বছরে ব্যয় ষাট আরএমবি। আর সাইকেলের যাবতীয় নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দায়িত্ব কোম্পানি। দু’টি কোম্পানি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। একটি অফো (ঙঋঙ) আর অন্যটি মোবাইক (গড়নরশব)। যারা লাল আর হলুদ রঙের সাইকেল বাজারে ছেড়েছে। কুনমিং শহরে প্রায় অর্ধ লাখ সাইকেল চলাফেরা করে। যা বাইরেই থাকে। আপনি যদি অ্যাপস নামিয়ে থাকেন তবে রাস্তায় নেমে মোবাইল দিয়ে বার কোড (ছজ ঈড়ফব) স্ক্যান করলেই সাইকেলের লক খুলে যাবে। আপনি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে সাইকেল লক করে চলে যান। অন্য যে কেউ এসে আবার একই পদ্ধতিতে সাইকেলের লক খুলে চালাতে শুরু করবে।
আর পথে যদি সাইকেল নষ্ট হয় ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে কল করলেই মেরামত কর্মীরা চলে আসবে যত দ্রুত সম্ভব। না এলেও আপনি সাইকেল রেখে অন্য কোনো সাইকেল নিয়ে পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে। রেখে যাওয়া সাইকেলটি কোম্পানির মেরামতকর্মীরা তাদের মতো এসে ঠিক করবে। আর রাতে সবশেষে কোম্পানি তার নিজস্ব পিকআপ ভ্যানে করে সাইকেলগুলো বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় মেরামত কাজ শেষ করে আবারো তাদের নিজস্ব স্ট্যান্ডে রেখে দেয়।
সবচেয়ে জনপ্রিয় সাইকেল কোম্পানি হচ্ছে অফো আর মোবাইকের বাইরে ইয়নচিং (ণড়হমধহীরহম) ও চতুর্থ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় একটি কোম্পানি। মোবাইকের সাইকেল নিতে নিরাপত্তা বাবদ জমা রাখতে হয় ২৯৯ আরএমবি আর অফোর জন্য ৯৯ আরএমবি। চীনের ২১টি শহরে বর্তমানে সাইকেল চলছে। আর সবই জিপিআরএস পদ্ধতিতে। আর অধিক চালালে পয়েন্ট যুক্ত হতে থাকবে আপনার ব্যক্তিগত হিসাবে। এতে বাড়বে নানান সুবিধাও। আর সাইকেল সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে কথা বলার জন্য রয়েছে কল সেন্টার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন