পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির দুটি মূলমন্ত্র সিপিইসি (চীন-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর) এবং আফগানিস্তান ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দুটিই পাকিস্তানের কৌশলগত ও কূটনৈতিক কার্যক্রমের জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জে পরিণত হতে যাচ্ছে। এত দিন পর্যন্ত সিপিইসির ফলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কেমন প্রভাব পড়বে এবং পাকিস্তানিদের জীবনযাত্রা কতটুকু উন্নত হবে তার আলোকেই এই প্রকল্পটি বিবেচনা করা হচ্ছিল।
কিন্তু সিপিইসি আসলে সবে শুরু হতে যাওয়া আন্তর্জাতিক ক্ষমতার রাজনীতির মূল বিষয়টিই সত্যিকারভাবে প্রতিফলিত করছে। সিপিইসি ইতোমধ্যে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন এবং কৌশলগত উপাদান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জোরালো বক্তব্য আসায় প্রকল্পটির ওই সম্ভাবনাই নিশ্চিত করেছে। এশিয়ায় এবং সেই সাথে পূর্ব আফ্রিকার কোনো ভূ-রাজনৈতিক হিসাব থেকেই সিপিইসিকে আর অগ্রাহ্য করা যাবে না।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি সিপিইসির উত্তর অংশকে ‘বিতর্কিত ভূখণ্ড’ হিসেবে অভিহিত করার সময় তিনি বুঝতে পারেননি, ওই ফ্রন্টে আমেরিকানরা আসলে তেমন কিছুই করতে পারবে না। ফলে তিনি আসলে ফাঁকা বুলিই কপচিয়েছেন। সম্ভবত তিনি তার সফরের আগ দিয়ে ইসলামাবাদের নীতি নির্ধারকদের সচেতন করার কাজটি করেছেন। এটা হয়তো একটি ফাঁদই, তবে আমি আশা করব, পাকিস্তানি আয়োজকরা তার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত থাকবে। আমি পরে ওই প্রসঙ্গে আসব।
অবশ্য এটাও সত্য, আমেরিকানরা সিপিইসির অপর তিনটি আন্তঃসংযোগ ইস্যুতেও আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এগুলো হচ্ছে: ভারত মহাসাগরে চীনের প্রদর্শন, যার মাধ্যমে এশিয়ার জায়ান্ট পরাশক্তি হওয়ার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, আর পাকিস্তানও এখন ধীরে ধীরে মার্কিন বলয় থেকে সরে চীনা বলয়ে চলে যাবে। তবে আরো কঠিন বিষয় হলো, পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার কারণে পাকিস্তান এখন আফগান জটিলতার কোনো স্থানেই ঠাঁই পাচ্ছে না।
দক্ষিণ এশিয়াভিত্তিক, বিশেষ করে পাকিস্তান-সম্পর্কিত নীতি প্রণয়নে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা নতুন কিছু নয়। বিষয়টি অনেক আগেই সুপ্রমাণিত। রিচার্ড হলব্রুক কিংবা এমনকি হিলারি ক্লিনটনের মতো অভিজ্ঞ কূটনীতিকরা তেমন কোনো সাফল্য দিতে না পারায় ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে ভবিষ্যতে কিছু পাওয়ার আশা করাটা বেশ অনিশ্চিত বলা চলে।
উত্তপ্ত রাজনীতিপ্রবণ এই অঞ্চলে এমনটা বেশ অনাকাঙ্খিত। পাকিস্তানি দৃষ্টিকোণ থেকে (এমনকি কেউ যদি পাকিস্তান কেন আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করতে চায়, সেই কারণকে ব্রাকেটে ফেলে রাখেও) আফগানিস্তানে ভারতের আরো বেশি ভূমিকা পালনের সাম্প্রতিক মার্কিন-ভারত সম্পৃক্ততায় দক্ষিণ এশিয়া রাজনীতি নিয়ে হোয়াইট হাউজের ব্যাপক একাডেমিক ও গবেষণার অভাবই ফুটে ওঠে।
মার্কিন নজরদারি থেকে সিপিইসিকে বাদ দেওয়া
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী পাকিস্তানের কাছ থেকে নিকট ভবিষ্যতে কী আশা করছেন? আমার মনে হচ্ছে, এ নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনা শুরু হতে পারে।
আমার ধারণা, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারকেরা তাদের চীনা প্রতিপক্ষদের কাছ থেকে সর্বোত্তম শিক্ষাটা গ্রহণ করছেন। কিংবা বলা যায়, তারা বেইজিংয়ের পরামর্শ অনুসরণ করছে। একে শিক্ষা গ্রহণের পর্যায় হিসেবে অভিহিত করা যায়। পাকিস্তান জানিয়ে দিয়েছে, তারা হাক্কানি নেটওয়ার্ককে দমনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যৌথ অভিযানে অংশ নিতে পুরোপুরি তৈরি হয়ে আছে। অথচ এটাই হলো দুই দেশের মধ্যে বিবাদের অন্যতম ক্ষেত্র। এখন পাকিস্তানের প্রস্তুতির খবরে ওয়াশিংটনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ‘আরো কিছু’ করার জন্য পাকিস্তানকে বলে আসছে। আর পাকিস্তান ‘একসাথে আরো কিছু’ করার কথা বলছে। এতে করে ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা পাকিস্তান আসার আগে এ নিয়ে ভাবতে পারবে।
শীর্ষ মার্কিন কূটনীতিকদের সাথে বৈঠকের সময় পাকিস্তানের কৌশল যদি হয় আফগানিস্তান প্রশ্নে সেটিকে অত্যন্ত দৃশ্যমান করে তোলা এবং এর মাধ্যমে আমেরিকান ও সেইসাথে ভারতের অভ্যন্তরীণ জনমতে স্থায়ী প্রভাব সৃষ্টি করা সম্ভব হয়, তবে সেটা হতে পারে প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র যদি সিপিইসি নিয়ে খোলামেলা মতবিনিময় করে, তবে অনেক ভালো হবে। পাকিস্তান যদি চায় মার্কিন নজরদারি থেকে সিপিইসিকে বাদ দেওয়া, তবে পাকিস্তানি কূটনীতিক এবং যারা মার্কিনিদের সাথে আলোচনা করবে, তাদের দরকার হবে ভারত যাতে আলোচনার বিষয়বস্তু না হতে পারে।
অর্থাৎ ভারত সম্পর্কিত বিষয়াদিকে আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য করা যাবে না। পাকিস্তানি ও আমেরিকানদের অবশ্যই আফগানিস্তান নিয়ে আলোচনা করতে হবে, ভারত নিয়ে নয়। সিপিইসি থেকে আমেরিকার নজর সরিয়ে নেওয়ার এটাই সম্ভাব্য রাস্তা হতে পারে। অবশ্য আমেরিকান অহমিকা বহাল থাকলে এবং পাকিস্তান যদি মূল সংলাপ থেকে ভারতকে বাদ দিতে না পারে, তখন বৈঠক হতে পারে আরেকটি ব্যর্থ প্রয়াস।
পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা থেকে ভারতকে বাদ দিতে পারলে সিপিইসি জয়ী হবে। ফলে সিপিইসিকে সামনে আনার আমেরিকান প্রয়াস ইসলামবাদকে দমন করতেই হবে। এই সমস্যার সমাধান হলো: আফগানিস্তান নিয়ে আলোচনা করো, ভারত নিয়ে নয়। পাকিস্তানের সামনে রয়েছে বিরাট সুযোগ। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।
লেখক: ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টমিনিস্টার, ইউকে-এর ডক্টরেট গবেষক। তিনি স্কুল অব গভার্নমেন্ট সোসাইটি, লাহোরের শিক্ষক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন