রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপর দেশটির সামরিক বাহিনীর নিধনযজ্ঞের পর সারাবিশ্ব তাদের নিন্দা জানানো ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার পরিকল্পনা করলেও তাদের অস্ত্র দেওয়া বন্ধ করেনি ইসরায়েল। তাদের এই অবস্থানের কারণে বিক্ষোভ করতে যাচ্ছে ইসরায়েলের মানবাধিকার কর্মীরা। সোমবার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের উপর নিধনযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করার কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ। এরপরও অস্ত্র বিক্রি অব্যহত রেখেছে ইসরায়েল।
২৫ আগস্ট মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার পর সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর নিধনযজ্ঞ চালানো শুরু করে। এই হত্যা ও ধর্ষণ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা। এই ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ বলে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ। এরপর সারাবিশ্বের তোপের মুখে পড়ে মিয়ানমার। তবে দেশটির সামরিক সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যহত রাখে ইসরায়েল। বিস্তারিত জানা না গেলেও জানা যায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে টহলনৌকা, বন্দুক ও নজরদারির সরঞ্জাম বিক্রি করেছে তারা। এছাড়া মিয়ানমারের বিশেষ বাহিনীকে প্রশিক্ষণও দিচ্ছে ইসরায়েল।
ইসরালেয়ের এই অবস্থানের প্রতিবেদানে মানবাধিকার সংস্থাগুলো্ আগামী ৩০ অক্টোবর ইসরায়েলের পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ করবে। মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের দাবি জানাবে তারা।
মিয়ানমার ছাড়াও ইসরায়েলি অস্ত্র ফার্মগুলো দক্ষিণ সুদানের জঙ্গিদেরও অস্ত্র বিক্রি করে বলে জানা গেছে। ২০১৩ সাল থেকেই দেশটি গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন প্রায় ৩ লাখ মানুষ।
মানবাধিকার আইনজীবী এইতায় ম্যাক ইসরায়েলের আদালতে পিটিশন দায়ের করেছেন যেন ওই রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের বাণিজ্য সম্পর্কের বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়। তিনি বলেন, এই মামলাগুলোর মাধ্যমে কর্মকর্তা ও কন্ট্র্যাক্টরদের যুদ্ধাপরাধ যাচাই করা হবে।
আল-জাজিরাকে ম্যাক বলেন. ‘অনেক পশ্চিমা দেশই অস্ত্র বিক্রি করে। কিন্তু ইসরায়েলের ব্যাপারটি আলাদা। যেখানেই আপনি যুদ্ধাপরাধ কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ দেখবেন, সেখানেই ইসরায়েলকে খুঁজে পাবেন।’ যারা এই অস্ত্র বিক্রি করে এবং যেই কর্মকর্তারা এর অনুমোদন দেয় তাদেরকে অবশ্যই্ আইনের আওতায় আনা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
ম্যাক মনে করেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কটা আসলে ইসরায়েলের পুরোনো ঐতিহ্যের প্রতিফলন। এই অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমেই ইসরায়েলের অর্থনীতি টিকে আছে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, অস্ত্র রফতানি লাইসেন্সের জন্য শতকরা ৯৯.৮ ভাগ সময়ই ইতিবাচকভাবে সাড়া দেয় প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা।
ম্যাক দাবি করেন, মিয়ানমার ও দক্ষিণ সুদানে অস্ত্র সরবরাহ ছাড়াও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে রুয়ান্ডা, বলকান, চিলি, আর্জেন্টিনা, শ্রীলঙ্কা, হাইতি, এল স্যালভ্যাদর ও নিকারাগুয়াতেও জাতিগত নিধনযজ্ঞে অস্ত্র দিয়েছিলো তারা। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যেও ভূমিকা ছিলো ইসরায়েলের।
তিনি বলেন, ‘এই অস্ত্র বিক্রিতে আমিসহ সব ইসরায়েলী অপরাধী হয়ে যায়। কারণ এগুলোর আমাদের নাম করেই পাঠানো হচ্ছে। আমরাই হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন দিচ্ছি।’
ইসরায়েলের ওপেন ইউনিভার্সিটির হত্যাযজ্ঞ বিষয়ক গবেষক ইয়াইর অরোন বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র দেওয়ার বিষয়টি হলোকাস্টের সময় জার্মানির নাৎসি বাহিনীর কাছে অস্ত্র দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করা উচিত।
এদিকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী আভিগদোর লিবারম্যানের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ আনে সংবাদমাধ্যম দ্য হারেতজ। লিবারম্যান পার্লামেন্টে দাবি করেছিলেন ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের নীতিতে বিশ্ব ‘আলোকিত’ হবে।
মিয়ানমারের সঙ্গে অস্ত্র বাণিজ্য নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি সরকারি কর্মকর্তারাও। গত মাসে এই অস্ত্র নিষেধাজ্ঞায় সুপ্রিম কোর্টে শুনানি ছিলো। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কথা বলার সময় রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়।
গত বছর একই্ আদালত এরকম একটি পিটিশনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছিলো। সেসময় দাবি করা হয়েছিলো যে ১৯৯০ দশকে বসনিয়ানদের উপর সার্বিয়ানদের হত্যাযজ্ঞ এর সময় ইসরায়েলের ভূমিকা কি ছিলো।
জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি বলেছেন, ‘মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহ করা যেকোনও দেশের এখন বিক্রি বন্ধ রাখা উচিত।’ ম্যাক বলেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের ঘটনায় সারাবিশ্ব এখন মিয়ানমারের নিন্দা করছে। এই অবস্থাতেই আসলে ইসরায়েলের ভূমিকা কি তা বোঝা উচিত।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লানও সামাজিক মাধ্যমে এক পোস্ট দিয়েছিলেন, যেখানে দেখা যায় তিনি ইসরায়েলে শীর্ষ অস্ত্র উৎপানদকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সফর করেছেন। একবছর পরে ইসরায়েলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মাইকেল বেন বারুশও মিয়ানমারে সফর করেন। তার উদ্দেশ্য ছিলো টহলনৌকা নিয়ে একটি চুক্তি করা। এর কিছুদন পর ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান টার আইডিয়াল কনসেপ্ট এর ওয়েবসাইটে এক ছবি প্রকাশ করা হয়। যেখানে দেখা যায় মিয়ানমার বিশেষ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তাদের স্টাফরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন