স্ত্রীর প্রতি এক শাসকের ভালোবাসার স্মারক তাজমহল এখনো পর্যটক আকর্ষণকারী বিশ্বের সেরা স্থাপনাগুলোর অন্যতম। এর প্রতিদ্বন্দ্বিদের মধ্যে রয়েছে চীনের মহাপ্রাচীর এবং পেরুর মাচু পিচু।
মোগল সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতিসৌধ ১৭ শতকে এই স্থাপনাটি নির্মাণ করেন। ভারতের নোবেল জয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন
‘এক বিন্দু নয়নের জল
কালের কোপল তলে শুভ্র সমুজ্জ্বল
এ তাজমহল।’
প্রতি বছর এই জাঁকালো কাঠামোটি দেখতে ৭০ লাখ লোক ভারতে যায়।
কিন্তু ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ একজন মুসলিম শাসকের নির্মিত হওয়ায় দেশটির ইতিহাসে এর কোনো স্থান নেই বলে যুক্তি দেওয়ায় এই স্থাপনাটি নিয়ে এখন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
বিজেপি নেতা সঙ্গীতসম স্থাপনাটিকে ভারতীয় সংস্কৃতির একটি কলঙ্ক হিসেবে অভিহিত করে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, মোগল যুগের ইতিহাস নতুন করে লিখা হবে। তার বিজেপি সহকর্মী সুব্রানিয়াম স্বামী বলেছেন, এক হিন্দু রাজার কাছ থেকে চুরি করা জমিতে তাজমহল নির্মাণ করা হয়েছে। আরেক পার্টি নেতা বিজয় কাতিয়ার দাবি করেছেন, হিন্দু রাজারা একে নির্মাণ করেছেন, তবে শাহজাহান সেটিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছিলেন। এসব অদ্ভূত দাবি ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
উত্তর প্রদেশ রাজ্যের আগ্রায় তাজমহলের অবস্থান। সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ একটি মন্তব্য করে এই সমালোচনা উস্কে দিয়েছেন। তিনি গত জুনে বলেছিলেন, তাজমহল ভারতীয় সংস্কৃতিকে প্রতিফলিত করে না। এরপরপরই উত্তর প্রদেশের পর্যটন পুস্তিকা থেকে বাদ দিয়ে মন্দিরের মতো অন্যান্য স্থাপনা তাতে যুক্ত করা হয়।
তবে গত সপ্তাহে সম্ভবত আদিত্যনাথ তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন এই বলে যে স্থাপনাটি সংরক্ষণ করা হবে, কারণ ‘ভারতের শ্রমিক এবং ভারত মাতার সন্তানদের রক্ত ও ঘামে এটি নির্মিত হয়েছে।’
তবে বিজেপি বলছে, একক কোনো স্থাপনা সম্পর্কে তাদের কোনো অবস্থান নেই, তারা মোগল আমল সম্পর্কে তাদের ধারণায় অটল রয়েছে।
বিজেপি মুখপাত্র জি ভি এল নরসীমা রাও বলেন, তাজমহল নিয়ে দলের কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই। তবে মুসলিম আমলটি ছিল চরম শোষণ ও অসহিষ্ণুতার যুগ। এটাই আমাদের দলের দৃষ্টিভঙ্গি।
১৫২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মোগল সাম্রাজ্য ১৮ শতক পর্যন্ত পুরো ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছিল। মোগল যুগের ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ ও কাঠামোর মধ্যে রয়েছে দিল্লির লাল কেল্লা। এখান থেকেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীরা স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ দিয়ে থাকেন। সম্রাট শাহজাহান ১৬২৮ থেকে ১৬৫৮ পর্যন্ত ৩০ বছর শাসন করেন। তার প্রিয়তমা তৃতীয় স্ত্রী মমতাজ তাদের ১৪তম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন।
সমালোচকেরা বলে আসছেন, তাজমহলের ওপর হামলা আসলে ধর্মীয় রেখার আলোকে ভারতের সমাজকে মেরুকরণের হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের চেষ্টা। তবে এই অভিযোগ বিজেপি অস্বীকার করেছে।
ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টোরিক্যাল রিসার্চের হরবংশ মুখিয়া বলেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের উদ্দেশ্য ইতিহাস চর্চা বা গবেষণা করা নয়। তারা আসলে ভারতের মুসলিমদের প্রতি বৈরিতা সৃষ্টি করছে।
অনেকে বলছে, ধর্মীয় রেখার আলোকে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে কলুষিত করাটা লজ্জার বিষয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সন্দ্বীপ শাস্ত্রী বলেন, আমি অনেক দিন ধরেই ভাবছি, দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে কখনোই কোনো ধর্মের হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক নয়। এটা সমন্বিত সংস্কৃতির প্রতিফলন। এটা ভারতের বহুসাংস্কৃতিক ও বহুধর্মীয় পরিচিতিকে প্রতিফলিত করে।
সরকার এই বিতর্ক থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে। উল্লেখ্য, স্থাপনাটি বর্তমানে দূষণের শিকার হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রী আফন্স কান্নানাথম ভারতীয় মিডিয়াকে জানিয়েছেন, তাজমহল গর্বের স্থানে রয়েছে।
তিনি বলেন, তাজমহল দেশের পর্যটন সার্কিটের কেন্দ্রে রয়েছে। উত্তর প্রদেশ সরকার নতুন নতুন স্থান খুঁজছে, তাজ আরো আগে থেকেই বিপুল জনপ্রিয়।
তবে বিরোধী দল একে কেন্দ্র করে বিজেপির সমালোচনা করছে। জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস দল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে ব্যাখ্যা দাবি করেছে। আর মোদি লাল কেল্লা থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়া বন্ধ করে দেবেন কিনা সেই প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ।
print
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন