ভারত উপর্যুপরি তৃতীয়বারের মতো রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে অসহায় অবস্থায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো। ভারতের নোংরামি শুরু হয় লাখ লাখ নারী, পুরুষ ও শিশুর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের নির্মম সামরিক অভিযান অনুমোদন করার মাধ্যমে। তারপর ভারতে পালিয়ে আসা ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে বহিষ্কার করার পরিকল্পনা ঘোষণা করে এই অজুহাতে যে তারা জিহাদি সন্ত্রাসীদের প্রজননক্ষেত্র। এবার তারা মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রশ্নে জাতিসংঘ কমিটির প্রস্তাবে ভোট দানে বিরত থাকলো।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর চালানো নৃশংসতার নিন্দা জানিয়ে আনা প্রস্তাবে যে ২৬টি দেশ ভোট দানে বিরত থাকে, তাদের মধ্যে রয়েছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও জাপান।
আর যে ১০ দেশ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়, তাদের মধ্যে রয়েছে চীন ও রাশিয়া। মিয়ানমার বা অন্য যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাশ্চাত্য নির্দেশিত যেকোনো ধরনের জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কথা জানিয়েছে চীন ও রাশিয়া। পাশ্চাত্য অন্যান্য দেশে তাদের হস্তক্ষেপ করার অজুহাত হিসেবে মানবাধিকার ইস্যুকে ব্যবহার করার প্রেক্ষাপটে তারা হলো ‘জাতীয় সার্বভৌমত্বের’ ‘ক্রুসেডার।’ মস্কো ও বেইজিং মনে করে, বিরোধটি মীমাংসায় তৃতীয় পক্ষকে না ডেকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের উচিত দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করা।
অবশ্য প্রস্তাবটির পক্ষে ১৩৫টি দেশ ভোট দেয়। যেসব দেশ প্রস্তাবটি সমর্থন করে তাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তান। ২৫ আগস্টের পর প্রবেশ করা ছয় লাখ নতুন রোহিঙ্গার ভার বাংলাদেশকেই বহন করতে হচ্ছে। আগে থেকে ছিল আরো চার লাখ। এখন দেশটিকে ১০ লাখ রোহিঙ্গার তদারকি করতে হচ্ছে।
পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তান মুসলমি রাষ্ট্র হওয়ায় বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মিয়ানমারের বৌদ্ধদের হাতে নির্যাতিত মুসলিম রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল।
‘থার্ড কমিটি’ নামে পরিচিত জাতিসংঘ প্যানেলটি মানবাধিকার ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করে। প্রস্তাবটি খসড়া হিসেবে পাস হয়েছে। এখন ডিসেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তা উত্থাপন করা হবে।
প্রস্তাবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ‘সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং মানবাধিকার অপব্যবহারকারী’ সামরিক অভিযান অবসানের জন্য দেশটির প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
এতে জাতিসংঘ তদন্ত কমিটিকে রাখাইন রাজ্যে প্রবেশের সুযোগ, মানবিক সহায়তা পূর্ণাঙ্গ ও নির্বিঘ্নে সরবরাহ করার সুযোগ দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এতে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার প্রদান করার জন্যও মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের সাথে আলোচনার জন্য একজন বিশেষ দূত নিয়োগের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতারেজের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
নতুন স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির অধীনে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় গত বছর একটি প্রস্তাব পাসের উদ্যোগ বাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চলতি বছর পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হওয়ায় এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হলো। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে নৃশংসতা চালানো হচ্ছে। সামরিক বাহিনীর নৃশংসতাকে জাতিসংঘ ‘জাতি নির্মূলের’ বাস্তব উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে।
নির্বিচার ধর্ষণ
মিয়ানমার ২০১৬ সালে আরো ছোট আকারের সামরিক অভিযানের সমরেকার মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তদন্ত করার উদ্যোগে রাজি হয়নি। মিয়ানমারবিষয়ক তদন্ত মিশনের চেয়ারম্যান হচ্ছেন মারজুকি দারুসমান (ইন্দোনেশিয়া)। এর দুই সদস্য হচ্ছেন রাধিকা কুমারীস্বামী (শ্রীলঙ্কা) এবং ক্রিস্টোফার ডোমিনিক সিডোতি (অস্ট্রেলিয়া)।
তবে কমিটি কক্সবাজরের উদ্বাস্তু শিবিরগুলো পরিদর্শন করে মিয়ানমার বাহিনীর ধর্ষণ ও হত্যাকা- সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য পায়।
এদিকে হলিউপ অভিনেত্রী, উদ্বাস্তুবিষয়ক জাতিসংঘ হাই কমিশনার এবং ‘যৌন সহিংসতা প্রতিরোধ উদ্যোগের’ সহ-প্রতিষ্ঠাতা অ্যাঞ্জেলিনা জলি রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতার তীব্র সমালোচনা করেছেন। ভ্যাঙ্কুভারে জাতিসংঘের একটি কনক্লেভে তিনি বলেন, ‘বুলেটের চেয়ে ধর্ষণ নারীর ওপর অনেক বেশি প্রভাব ফেলে।’
বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল মাহফুজুর রহমান যৌন নির্যাতন ও সহিংসতাবিষয়ক এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নারীদের বিপর্যয়ের ব্যাপারে জলির সহযোগিতা কামনা করেছেন। এ ব্যাপরে জলি বলেন, তিনি যৌন সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গা নারীদের দেখার পরিকল্পনা করছেন। তিনি উদ্বাস্তুদের প্রতি বাংলাদেশের উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করেন।
চলতি সপ্তাহের প্রথম দিকে সংঘাতে যৌন সহিংসতাবিষয়ক জাতিসংঘ বিশেষ দূত প্রামিলা প্যাটেন ঢাকায় বলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা ছিল মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনীর পরিকল্পিত কাজ।
নির্বিকার আসিয়ান
জাতিসংঘ যখন অনেক দূরে যুক্তরাষ্ট্রে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা করছির, একই সময় দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ান জোট আসিয়ান তাদের অঙ্গনেই সংঘটিত বিষয়টি অগ্রাহ্য করে যায়।
রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের জন্য সু চিকে আহ্বান জানিয়ে কোনো প্রস্তাব পাস করতে ব্যর্থ হয় আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন। সম্মেলনে কয়েকটি দেশ মাত্র বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনি গুতারেস।
ট্রুডো ও গুতারেস রোহিঙ্গা ইস্যুকে এড়িয়ে যাওয়ায় আসিয়ন সদস্যদের হুঁশিয়ার করে বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি ‘আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা ও চরমপন্থার সৃষ্টি করতে পারে।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বেশির ভাগ আসিয়ান সদস্যই মিয়ানমারের ওপর পর্যাপ্ত চাপ সৃষ্টি করেনি। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর গণহত্যা বন্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবও তারা আনেনি। আরো দুঃখজনক হলো, শীর্ষ সম্মেলন মানবাধিকার কর্মী ও বেসামরিক লোকদের মুক্তির মতো ইস্যুগুলো পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে যায়।
চীনের উদ্যোগ
এদিকে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেং শুয়াং বেইজিংয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং ইয়ি ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং পারস্পরিক আঞ্চলিক উদ্বেগ’ নিয়ে মত বিনিময়ের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করবেন। তবে তিনি রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা করবেন কিনা সে ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি।
অবশ্য রোহিঙ্গা সমস্যাটি দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করার জন্য বসার জন্য মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে রাজি করানোর চেষ্টা করছে চীন। এর ফলে চীনা বিশেষ দূত সান গুয়াজিয়াংয়ের চেষ্টায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা ঢাকায় মিলিত হয়ে ১০ দফা কর্মসূচিতে একমত হন। কিন্তু মিয়ানমার পরের দিনই তা থেকে সরে আসে।
তবে দেশটি অব্যাহতভাবে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের কথা বলে আসছে। নভেম্বরের শেষ দিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করবেন বলে জানানো হয়েছে।
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী সোমবার ও মঙ্গলবার মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদো’তে এশিয়া-ইউরোপ সম্মেলন যোগ দেবেন। এতে বাংলাদেশ ছাড়াও পাশ্চাত্যের দেশগুলো অংশ নেবে। এখানেও নিশ্চিতভাবে রোহিঙ্গা ইস্যু আলোচিত হবে। আশা করা যায়, জাতিসংঘ এবং পাশ্চাত্য হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে চীনা কঠোর অবস্থানের ফলে পাশ্চাত্য ও জাতিসংঘ তাদের প্রয়াস দ্বিগুণ করে রোহিঙ্গা প্রশ্নটি সমাধান করতে বাধ্য করবে মিয়ানমারকে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন