কিছু দিন আগে কথা। আলজেরিয়ার লে হিক নামের এক কার্টুনিস্ট তার কলমের কয়েকটি খোঁচায় সৌদি পুরো পরিস্থিতি তুলে ধরেন। অঙ্কিত কার্টুনে দেখা যায়, সৌদি বাদশা একদিকে সন্ত্রাস দমনের ফিরিস্তি ঘোষণা করছেন, অন্যদিকে নিজের মাথার দিকে একটি বন্দুক তাক করে রেখেছেন। এই কার্টুনে সৌদি আরবের পুরো বাস্তবতা চিত্রায়িত করা হয়েছে। অর্থাৎ সৌদি আরব নিজেই ইসলামি ‘মৌলবাদ’ এর উৎপাদন ও পৃষ্ঠপোষকতা করছে, আর সেই ইসলামিজমই দেশটির ভিত্তি ও ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
.
কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে প্রায় তিনশ’ বছর আগে ফিরে যেতে হবে। ১৭৪৪ সালের কাছাকাছি সময়ের কথা, উপজাতীয় প্রধান মোহাম্মাদ ইবনে সৌদ অতি রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতা মোহাম্মাদ ইবনে আবদ আল ওয়াহহাবের সঙ্গে জোট করেন এবং প্রথমবারের মতো আরব উপদ্বীপে রাজতন্ত্রীয় রাষ্ট্র কায়েম করেন। একদিকে রাজকীয় পরিবার, অন্যদিকে ধর্মীয় নেতৃত্ব- এই দুই গ্রুপ বেশ ঐক্যবদ্ধভাবে দশকের পর দশক এই রাষ্ট্র শাসন করছে। আর এই রাষ্ট্র পরিচালনার মূল রশদ হলো তেলের রাজস্ব এবং ইসলামের পবিত্র স্থানগুলোর বৈধতা প্রাপ্তি সূত্রে প্রাপ্ত অর্থ।
কিন্তু বর্তমান সময়ে ওহাহাবিজমকে জিহাদিদের অন্যতম উৎপাদন ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। আর এটি ইসলামপন্থী শক্তিগুলোর অন্যতম উৎস। সৌদি আরব সেটিকে লালন-পালন করছে, আর সেই পালিত ইসলামবাদ সৌদি আরব ও বিশ্বের অন্যান্য দেশকে আস্তে আস্তে খেয়ে ফেলছে।
পশ্চিমা বিশ্ব বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছে। কারণ ইতোমধ্যে সেখানে বেশ কিছু হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সৌদি নেতারা পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে মোলাকাত করছেন, হাসাহাসি করছেন অথচ যেসব ধর্মগুরু লোকজনকে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করছেন তাদের ঠিকই আশ্রয় দিচ্ছেন। এখন মানুষ সেটা আরো স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছে।
সৌদি আরবে সংস্কার দরকার, কিন্তু একই সাথে সেটি অসম্ভবও। কারণ সৌদি রাজপরিবারকে যে ধর্মীয় নেতারা সমর্থন দিচ্ছেন তাদেরকে তারা কিভাবে এড়িয়ে যাবেন, কিংবা বিশ্বব্যাপী ‘মৌলবাদ’-এর জন্য তারা যে অর্থ ঢালছেন তা কি বন্ধ করতে পারবেন, অথবা দেশের ভেতরেই যে সামাজিক অধিকার নিয়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে সেটাই বা তারা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন। সৌদি আরবের স্থিতিশীলতা এখন বিপন্ন, আর তার প্রভাব পড়ছে অত্র অঞ্চলেও।
সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী ৩২ বছর বয়সী যুবরাজ মোহাম্মাদ, যিনি ইতোমধ্যে আয়রন ম্যান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন, মনে করছেন, এই সংকটের সমাধান আছে। উৎসাহী এই তরুণকে সংস্কারক হিসেবে দেখা হচ্ছে। দুই বছর আগে যখন তার পিতা তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান তখন থেকেই রাজনীতিতে নিজের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ় করেছেন তিনি।
আর এর স্বাক্ষর রাখতে তিনি বেশ কিছু সংস্কার কাজ হাতে নিয়েছেন। সেসবের উদ্দেশ্য হলো-দেশটিকে একমাত্র তেলের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে উদ্ধার করা। এ জন্য তিনি নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন, আরো তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র নির্মাণ এবং দেশকে পর্যটনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া ইত্যাদি উদ্যোগ নিয়েছেন।
এ ছাড়া সৌদি যুবরাজ, যিনি এম বি এস (মোহাম্মাদ বিন সালমান) হিসেবে পরিচিত, দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশটিতে নারীদের গাড়ি চালানো এবং স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এমনকি দেশটিতে সিনেমা হল পুনরায় খুলে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে দেশটির ধর্মীয় নেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি হাদিস ও ইসলামী আইনকানুন পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দিয়েছেন যুবরাজ। এর সবই তার সেই সংস্থকারেরই অংশ।
এ সবই ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ। সৌদি আরবে এখন যা ঘটছে, বিশেষ করে, বৃদ্ধ বাদশার প্রতি অসন্তোষকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র বা ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টির সদৃশ বলে মনে করা হচ্ছে। অধিকন্তু, ইরানের হুমকি মোকাবিলায় সৌদি সরকার যে নতুন সতর্কতা জারি করেছে তা এবং ইসরাইলের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেও এইসব পরিবর্তন বা সংস্কার প্রস্তাবের মিল রয়েছে। কোন ধরনের বিপ্লবী এই যুবরাজ?
কেউ কেউ মনে করছেন, মধ্যপ্রাচ্যকে নিজেদের জন্য কণ্টকমুক্ত করতে আমেরিকা সৌদি যুবরাজকে দিয়ে এসব করাচ্ছে।
এই সব সংস্কার সৌদি আরবে প্রকৃতপক্ষে কী প্রভাব ফেলবে সেটা না হয় পরের কথা, কিন্তু অন্যত্র এর যে প্রভাব পড়বে তা ইতোমধ্যে অনুভূত হচ্ছে। যদি সৌদি আরব, যেখানে ফতোয়ার উৎপত্তি হয়, এই সব সংস্কার কাজ শুরু করে তাহলে বিশ্বের ইসলামপন্থীরা ইসলামের মূল বিধান থেকে সরে আসার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
উদাহরণস্বরূপ আলজেরিয়ার কথা ধরা যাক। দেশটির কট্টরপন্থীরা সৌদি যুবরাজের এই সব উদ্যোগে যে অস্বস্তিবোধ করছেন তা স্পষ্ট। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আলোচনা তুঙ্গে এবং বলা হচ্ছে, এম বি এস-এর অবস্থান আমেরিকার প্রডাক্ট। কিন্তু রক্ষণশীল গণমাধ্যম এবং ইসলামিক সম্পাদকীয় লেখকরা- যারা কোনো কিছু হলেই সৌদি আরবের সমালোচনা করতে আগ্রহী- এই মুহূর্তে এক প্রকার নীরব অথবা ওয়াহাবিজম রক্ষা নিয়ে তারা শঙ্কিত। তাছাড়া মসজিদগুলোতেও এখন নীরবতাই বিরাজ করছে।
আলজেরিয়ায় ইসলামপন্থীরা দুই শিবিরে বিভক্ত। একটি গ্রুপ জন্ম বা বংশ সূত্রে মুসলমান। যারা নিজেদের সঠিক দাবি করে, ফতোয়া কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে সৌদি আরবকে অনুসরণ করে তারা। কিন্তু সৌদি যুবরাজের সংস্কার প্রস্তাবের কারণে তারা শঙ্কিত। কারণ ওই সংস্কার বাস্তবায়ন হলে তাদের অর্থের সরবরাহ বন্ধ হবে এবং তারা তাদের বৈধতা হারাবে।
অপর পক্ষটি হলো, মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থিত এবং তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের খুব কাছের। এই আদর্শের রাজনৈতিক দলকে আলজেরিয়া সরকার বৈধতা দিয়েছে। তবে এর সদস্যরাও এখন উদ্বিগ্ন। কারণ সৌদি আরবে সংস্কার হলে তারা ইসলামপন্থীদের সহনশীলতা যেমন হারাবে তেমনি আলজেরিয়ার রাজনীতিতে তাদের ধস নামবে। সৌদি যুবরাজ অন্য মডারেটদের চেয়ে অধিক মডারেট হতে গিয়ে যেন তাদের পায়ের তলার কম্বল টেনে বের করছেন।
অবশ্য, এসব কারণে, সব ধরনের মুসলমান এক প্রকার অভিভাবকহীন হওয়ার উদ্বিগ্নতায় রয়েছেন। মডারেট গ্রুপ, যারা অন্ধ অনুকরণ করে, যুবরাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তার সঙ্গে দেখা করতে পারে। কিন্তু ‘মৌলবাদী’ গ্রুপ ও এর সমব্যথিতরা মিলে নতুন কোনো বৈধতার দাবিতে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যেতে পারে অথবা পবিত্র ভূমির (মক্কা, মদিনা) বিরুদ্ধে একটি পবিত্র যুদ্ধের আয়োজন করতে পারে। সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন