মাস তিনেক আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন যে দক্ষিণ এশিয়া নীতি ঘোষণা করেন, তা নয়াদিল্লিতে বেশ আশাবাদ জাগিয়েছিল। ইসলামী জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেয়ার অপরাধে পাকিস্তানকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি ভারতের দিকে কিছুটা পক্ষপাতও ছিল এতে। আগামী শতকের জন্য যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন সম্প্রতি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে মার্কিন দক্ষিণ এশিয়া নীতির বিষয়টি আবারো আলোচনায় এসেছে। ‘অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল’ ধারণা নিয়ে যে নীতি ঘোষণা করা হয়েছে তাতে ওয়াশিংটন-নয়াদিল্লির সম্পর্কে নতুন সুবাতাস বইছে।
চীনের সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘গ্লোবাল টাইমস’-এর এক নিবন্ধে প্যানগোল ইন্সটিটিউটের গবেষক মাও কেজি লিখেছেন, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অংশগ্রহণমূলক কৌশলগত আগ্রহের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। এ অঞ্চলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন যখন দ্রুততার সাথে এগিয়ে চলেছে, তখন কিভাবে তারা তাদের কৌশলগত অংশীদারিত্বকে স্থায়ী রূপ দেবে – তা খানিকটা জটিল বটে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের সাধারণ পারমাণবিক চুক্তির ক্ষেত্রেও দুই দেশের মধ্যে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি উঠে এসেছিল। জোটের বাইরে বেরিয়ে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লি কি চেষ্টা করেছে, সেই বিষয়টিও স্বচ্ছ নয়। যেহেতু কোনো পক্ষই খুব একটা ছাড় দিতে আগ্রহী নয়, তাই সব সময় সম্পর্কে একটা ফাটল থেকেই গেছে। উদাহরণস্বরূপ, যে মার্কিন কর্মকর্তা বহু বছর ধরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে ভারতকে পারমানবিক শক্তিধর স্ট্যাটাস দেয়ার পক্ষে কাজ করছে, ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্বশাসনের দাবির কারণে খুবই হতাশ হতে হয়েছে তাকে।
আজ কি ভারত আর যুক্তরাষ্ট্র নতুন স্থায়ী কোনো সম্পর্কের সূচনা করতে পারে? সম্পর্কটা ঝালিয়ে নিতে কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজেদের ভূমিকা পরিস্কার করে নিতে হবে।
দু-দেশের নীতি-নির্ধারকরা স্বাচ্ছন্দের একটা অবস্থানে যেতে চান। ওয়াশিংটন এবং নয়াদিল্লিকে অনেকগুলো বিষয়ে চরম পরস্পরবিরোধী অবস্থানের মধ্যে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করতে হয়। প্রতিপক্ষের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ অথবা নিজের অবস্থান আঁকড়ে থাকা- এছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
ভারতের একগুয়ে ‘কৌশলগত স্বায়ত্বশাসনে’র কাছে সমর্পণ করতে হলে ওয়াশিংটন হয়তো বিশ্বসভায় ভারতের উত্থানকে সমর্থন যুগিয়ে যাবে। কিন্তু বিপরীতে ভারত যে তাকে বিশেষ কোনো প্রতিদান দেবে সে প্রত্যাশা করতে পারবে না।
বিষয়টাকে সবচেয়ে ভালোভাবে গুছিয়ে বলেছেন ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ক কৌশলবিদ অ্যাশলি টেলিস: ‘ভারত তাদের নিজস্ব উন্নয়ন ও কৌশলগত উন্নতি অব্যাহত রাখার মাধ্যমে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখবে যাতে চীন কখনো এশিয়ায় প্রাধান্য বিস্তার করতে না পারে। সে কারণেই এ অঞ্চলে মার্কিন নীতির দিকে ঝুকবে তারা।’ তার মতে, ভারতের উত্থানে সহায়তা করলে ওয়াশিংটনের উপর চীনের প্রভাব এমনিতেই কমে যাবে। এ যুক্তি নয়াদিল্লিতে খুবই গ্রহণযোগ্যতা পাবে। কারণ তাতে ভারতের দায়দায়িত্ব কমে যাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ও তার মিত্র দেশগুলোতে এ নিয়ে উদ্বেগ বাড়বে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ ধরনের একতরফা দরকষাকষি ট্রাম্পের ‘সবার আগে আমেরিকা’ নীতির সাথে খুব একটা খাপ খাবে না। যেখানে সে বরাবরই তার দর-কষাকষির দক্ষতা নিয়ে গর্ব করে আসছে।
বিকল্প হিসেবে ওয়াশিংটন হয়তো সম্পর্কের দেয়া-নেয়া নীতির উপর জোর দিতে পারে, ইন্দো-মার্কিন কৌশলগত অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে যেটাকে বলা যেতে পারে মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ ধরনের অংশীদারিত্বের সম্পর্ককে হয়তো সমতার দৃষ্টিতে ভালো দেখাবে কিন্তু সামরিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং কূটনৈতিক শক্তির বিচারে মার্কিন বলয়ের মধ্যে নয়াদিল্লি একেবারে হারিয়ে যাবে বলা যায়। ভারত হয়তো খুব দ্রুতই টের পাবে যে যুক্তরাষ্ট্রকে যতটা দিতে পারছে তারা, তার চেয়ে আরো অনেক বেশি ফেরত চায় তারা।
ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্বশাসনও হয়তো মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে, যদি ওয়াশিংটনের কাছে তাদের দেনা এতটা বেড়ে যায়। যেটা পরিশোধ করা সম্ভব নয়।
নয়াদিল্লির জন্য এটা আদর্শ যে তারা সব ধরনের মার্কিন সহায়তা উপভোগ করবে, একইসাথে তাদের সাধের কৌশলগত স্বায়ত্বশাসনের নীতিও আঁকড়ে থাকবে। ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্বশাসন বলতে এখানে যেটা বোঝায় সেটা হলো একটা স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি- যেখানে বাইরের কোনো বিধিনিষেধ থাকবে না। তবে, এটা ঠিক হওয়ার মতো নয়। এটা সত্যি যে, ভারতের কৌশলগত ভৌগলিক অবস্থান এবং সম্ভাবনা তাকে এশিয়াতে একটা ভারসাম্যপূর্ণ জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। যে কারণে তাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাদের দিক থেকে যে কাঠামোগত চাপের মুখোমুখি হয়, সেটা মার্কিন সহায়তা একচেটিয়াভাবে পাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের জন্য সেভাবে ইতিবাচক নয়, যেভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘লেন্ড-লিজ’ নীতির সুবিধা পেয়েছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন।
ভালো খবর হলো, যে ব্যক্তি ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এবং বিশ্বসভায় ভারতের অবস্থান নিয়ে যার ব্যাপক উৎসাহ, সেই মোদীকে দেখা যাচ্ছে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তার পূর্বসূরীদের তুলনায় অনেক নমনীয়। যদিও মার্কিন সমর্থনের জন্য কৌশলগত স্বায়ত্বশাসনের জায়গায় নয়াদিল্লি কতটা ছাড় দেবে, তা এখনো পরিস্কার নয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইন্দো-মার্কিন সাধারণ পারমাণবিক চুক্তির পর নয়াদিল্লি যদি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কাছে আত্মসমর্পণ করতো তাহলে তারা লিবিয়া বা সিরিয়ায় পশ্চিমা হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে অবস্থান নিতে, ইরানের কাছ থেকে জ্বালানি আমদানি অব্যাহত রাখতে বা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় মার্কিন তৎপরতায় আপত্তি জানাতে পারতো না। এইসব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে ভারত কি রাজি হবে? মনে হচ্ছে, যতক্ষণ না বাইরের হুমকি ভারতের জন্য চাপের কারণ হয়ে উঠছে, নয়াদিল্লি ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের কৌশলগত স্বায়ত্বশাসন নীতিতে ছাড় দিতে রাজি হবে না।
দুই পক্ষের পছন্দ, চাহিদা ও কৌশলগত হিসেব-নিকেশের পার্থক্যের কথা বিবেচনায় নিলে বলা যায় পরিপূর্ণ ইন্দো-মার্কিন কৌশলগত অংশীদারিত্বের বিষয়টি এখনো অনিশ্চিতই রয়ে গেছে। এ অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে ভারতের সাথে হাত মেলানোর ব্যাপারে একমত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যেটা পাকিস্তানের সাথে ওয়াশিংটনের আগের সম্পর্ক বা দক্ষিণ এশিয়ার চীনের অবস্থানের ব্যাপারে নয়াদিল্লির উদ্বেগ দূর করেছে। অন্যদিকে ভারতও তাদের অস্ত্রভাণ্ডারকে আরো ‘মার্কিনীকরণের’ ব্যপারে এবং যৌথ সামরিক তৎপরতা বাড়ানোর ব্যাপারে একমত হয়েছে।
অগ্রগতি যা হয়েছে তা সন্তোষজনক হলেও, ‘অবাধ-মুক্ত ইন্দো-প্রশান্ত’ নীতির আলোকে কৌশলগত অবস্থানে পৌঁছার জন্য দু-পক্ষেরই এখনো অনেক দূর যাওয়ার বাকি আছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন