মিশরের সিনাই উপদ্বীপের আল-রাওদা মসজিদে শুক্রবার জুম্মার নামাজ আদায়রত মুসল্লিদের উপর সন্দেহভাজন জঙ্গিদের চালানো হামলায় এ পর্যন্ত ২৩৫ জনেরও বেশি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও বহু। আধুনিক মিশর ও সিনাই উপদ্বীপের ইতিহাসে এই হামলাকে সবচেয়ে বর্বরতম হামলা হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
আফ্রিকা ও এশিয়ার মাঝে ত্রিকোনাকার সিনাই উপদ্বীপ সন্ত্রাসবাদের আখড়া হয়ে উঠছে গত বেশ কয়েক বছর ধরে। উপদ্বীপের উত্তরাংশে ইসলামিক স্টেটের(আইএস) শক্ত অবস্থান আছে বলে মনে করা হয়। সিনাইতে আইএস নিজেদের অবস্থান শক্ত করার পাশাপাশি স্থানীয় সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠিগুলোকেও উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে।
শুক্রবারের বর্বরতম হামলার দায়িত্ব এখনো কেউ স্বীকার করেনি। তবে এ হামলায় ইসলামিক স্টেটের ছাপ স্পষ্ট।
২০১১ সালে আরব বসন্তের উত্তাপে হুসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সিনাইতে হঠাৎ করেই সন্ত্রাসবাদ বেশ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ২০১৩ সালে মোবারকের উত্তরসুরি মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর এ সন্ত্রাসবাদ অরেকদফা বৃদ্ধি পায়। সে সময় পুরো সিনাই উপদ্বীপে মারাত্মক নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরী হয়।
২০১৩ সালে মিসরের তৎকালীন সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি সিনাইতে বড় ধরণের এক সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালান। ইসলামিক স্টেট ও স্থানীয় অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠিগুলোর বিরুদ্ধে এ অভিযানে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে মিশরের সেনাবাহিনী। এ অভিযান স্থানীয় মানুষদের ক্ষেপিয়ে তোলে। স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠি ‘দ্য উইলায়াত সিনাই‘ আইএসের সাথে নিজেদের ঐক্য ঘোষণা করে। এ জঙ্গিগোষ্ঠিটি বহু হামলার পেছনের মূল কারিগর। তাদের হামলায় এ পর্যন্ত কয়েকশ’ মানুষ মারা গেছে।সিসি পরে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে ২০১৪ সালে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানে মুরসিকে হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় বসেন। মুরসির রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডকে মিসরে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এরপর সিনাইতে আরেক দফা সন্ত্রাসবাদের উত্থান হয়।
২০১৫ সালের অক্টোবরে একটি রুশ বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করার দায় স্বীকার করে উইলায়াত সিনাই। ওই ঘটনায় বিমানটিতে থাকা ২২৪ আরোহীর সবাই নিহত হয়েছিলেন।
এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠিটি সাধারণত কপটিক খ্রিস্টান, চার্চ ও নিরাপত্তাবাহিনীর উপর ধারাবাহিকভাবে হামলা চালিয়ে আসছিল।
সিনাইয়ের স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠিগুলো স্থানীয় বেদুঈন উপজাতিগুলোকেও সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে। এ উপজাতিরা বহু বছর ধরে সরকারের নজরের বাইরে আছে। মিসর ধাপে ধাপে উন্নতি করলেও এসব উপজাতিদের জীবনমানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। অনেক বেদুঈন সম্প্রদায়ই বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করতে পারে না।
লাশের সারি
মসজিদের ভেতর লাশের সারি। ছবি: ইপিএ
বেদুঈন সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষই ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অনেকে আবার আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করছে। কিন্তু এসব সম্প্রদায়ের কিছু কিছু মানুষ আবার জঙ্গিগোষ্ঠিগুলোতে যোগও দিচ্ছে। বেদুঈন সম্প্রদায়গুলো আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল। তাই তারা অবৈধ কর্মকাণ্ড, মাদক চোরাচালান ও নানা ধরণের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
সিনাইয়ের উত্তরাংশে নিরাপত্তাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রায় নেই। উইলায়াত সিনাই ওই অংশের নিয়ন্ত্রণে আছে। সিনাইয়ের উত্তরাংশে মরুভূমি এবং দক্ষিনাংশে পাহাড় থাকায় নিরাপত্তাবাহিনীর জন্যও সিনাইয়ের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
সিসি কি এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে?
শুক্রবার যেভাবে জঙ্গিরা এ ভয়াবহ হামলা করেছে তাতে নতুন করে আবারও প্রশ্ন উঠেছে, সিনাইয়ের পরিস্থিতি কি প্রেসিডেন্ট সিসি মোকাবেলা করতে পারবে? পুরো মিসরের জন্যই এটি এখন এক বিরাট প্রশ্ন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শুক্রবারের জুম্মার নামাজ যখন প্রায় শেষের দিকে, তখন জঙ্গিরা মসজিদটির উপর বোমা বর্ষণ করে। এরপর পলায়নরত মুসল্লীদের উপর অনবরত গুলিবর্ষণ করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পাহাড়ি পথে চলতে সক্ষম এমন অন্তত ৪০টি গাড়ি ও ভারী অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে জঙ্গিরা এ হামলা চালায়।
শুক্রবারের হামলার পেছনে যদি ইসলামি স্টেটের হাত থাকে, তাহলে এটি বৃহত্তর পরিসরে ভাবনার খোরাক রাখে। গত কয়েক মাসে উরাক ও সিরিয়ায় আইএস তাদের অনেক ভূমি হারিয়েছে।
এই হামলার পেছনে যদি আইএস থাকে, তাহলে তারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা তাদের সমর্থকদের এ বার্তা দিতে চাইছে যে, তারা এখনো শক্তিমান, লড়াইয়ের মাঠে আছে এবং শত্রুদের উপর এমন বড় পরিসরে হামলা চালাতে সক্ষম। এ হামলা আইএস সমর্থক ও যোদ্ধাদের চাঙা করে তুলবে।
কিন্তু সিনাইয়ের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে প্রেসিডেন্ট সিসি ঠিক কী ধরণের পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সেটি এখনো জানা যায়নি। কয়েক বছর ধরে তিনি সিনাইয়ে সেনা অভিযানের দিকেই বেশি জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু এসব অভিযান যে ব্যর্থ তা বারবার প্রমাণ হয়েছে।
এখন এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সিনাইয়ের জন্য সিসি নতুন কোনো দাওয়াই আনবেন কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে শুক্রবারের হামলার পর জাতির উদ্যেশ্যে দেওয়া এক টিভি ভাষণে প্রেসিডেন্ট সিসি বলেছেন, ‘সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করা হবে।’
প্রিয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন