জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সেখানে স্থানান্তর করতে যাচ্ছেন, সৌদি আরবে সফরে যেয়ে সেই ট্রাম্পের বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজের সঙ্গে তরবারি নৃত্যের কথা অনেকের মনে আছে। অনেকের এও মনে আছে সৌদি বাদশাহ বিরাট এক স্বর্ণের মালা ট্রাম্পের গলায় পড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন হয়ত ভ্রম মনে হতে পারে, তা বানরের গলায় মুক্তোর মালা ছিল কি না!
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়া অনেক আগেই লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। শান্তির বাইরে মধ্যপ্রাচ্যকে যুদ্ধের ডামাডোলে ঠেলে দিলে অস্ত্র বিক্রির সুযোগ বেড়ে যায়, এমন সুযোগ পশ্চিমা দেশগুলো ছাড়বে কেন? আরব বিশ্ব বা পশ্চিমা দেশগুলো যতই ট্রাম্পের জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণার নিন্দা জানাক, ইসরায়েলের শীর্ষ নেতারা কিন্তু জানান দিয়ে রেখেছে অনেক আরব দেশ গোপনে তাদের সঙ্গে সখ্যতা বজায়ে রেখেছে যা অদূর ভবিষ্যতে প্রকাশ্যেরুপ নেবে।
কেন ট্রাম্প এধরনের ঘোষণা দেওয়ার জন্যে এমন যুৎসই সময় বেছে নিলেন যখন আইএস জঙ্গিরা সিরিয়া ও ইরাক থেকে পর্যুদস্ত, যখন সৌদি জোট ইয়েমেনে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছে, কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। স্বয়ং মার্কিনীরা বলছেন, ট্রাম্পের এ ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যে টানা যুদ্ধের সূচনা করবে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ায় একের পর এক সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে, এসব দেশের সম্পদ ও জনবলকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন মুসলিম নিষিদ্ধ করার নীতি নিয়ে পররাষ্ট্রনীতিতে মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছে।
এহেন পরিস্থিতিতেও বিশ্ব মুসলিম উম্মার অভিভাবক ও পবিত্র দুই মসজিদের খাদেমদের ইসরায়েল-মার্কিন প্রীতিতে কোনো ভাটা পড়ার লক্ষণ নেই। বরং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে ক্রাউন প্রিন্স তার রাজকোষ পরিপূর্ণ করে তুলছেন। বায়তুল মুকাদ্দাস হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে আর পশ্চিমা সঙ্গীতের মূর্ছণায় ইয়ানির কনসার্টে সৌদি নারী পুরুষরা আকণ্ঠ ডুবে আছেন।
প্রভাবশালী ইহুদি লেখকরা বলছেন, ট্রাম্পের চারপাশে যে ইহুদি লবি আছে, তার সাথে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ও রিপাবলিকান মেগা ডোনার হিসেবে পরিচিত শেলডন আদেলসনের চাপে ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বসেছেন। তবে এর ফলাফল হবে এক বিশাল ‘শূন্য’। কঠিন সমালোচনা হচ্ছে ট্রাম্পের, তা হোক কিন্তু পরিণতির দিক থেকে তা কিছুই নয়।
৭০ বছর আগে ট্রাম্পের পূর্বসূরী হ্যারি ট্রুম্যান ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ওই সমর্থন ফিলিস্তিনকে খন্ড বিখন্ড করতে জাতিসংঘের গ্রহণযোগ্যতার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ট্রাম্প খুব ভাল করেই জানেন এখন তার এ স্বীকৃতিকে সমর্থন দিতে দেশের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে। অতীতেও ট্রুম্যান যখন ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেন তার আগে যুক্তরাষ্ট্র তৎকালীন সৌদি আরব ও তার বাদশাহকে ফিলিস্তিনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা ও ইহুদিদের বিরদ্ধে অবস্থান না নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। এবার ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে সৌদি আরবে ডেকে নিয়ে এধরনের পরিস্থিতি মেনে নেয়া বা বিকল্প হিসেবে পদত্যাগ করার কথা বলা হয়।
ট্রাম্প যখন দেখেন আদতেই আরব দেশগুলো গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে তখন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে ডেকে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর কোনো ‘রা’ না করার পরামর্শ দেওয়ার উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশারী পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমস সৌদি বাদশাহর প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে ডেকে নিয়ে মার্কিন-ইসরায়েল শান্তি প্রক্রিয়ার ব্যাপারে যে নসিহত করেছেন তার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে গত সপ্তাহেই। পত্রিকাটি বলছে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে সাফ জানিয়ে দেন পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করার প্রত্যাশা ফিলিস্তিনিদেরকে ছেড়ে দিতে হবে। তার মানে পশ্চিম ও পূর্ব জেরুজালেম ইসরায়েলের রাজধানীতে পরিণত হতে যাচ্ছে।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ট্রাম্পের জেরুজালেম স্বীকৃতি ঘোষণার পর বলছেন যে তা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়াকে শুধু বিনষ্ট করবে না বরং দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সম্ভাবনা চিরতরে তিরোহিত হয়ে যাবে। কিন্তু এই সেই মাহমুদ আব্বাস যিনি ২০০০ সালে আল-আকসা ইন্তিফাদা বন্ধ করতে ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। যখন তখনকার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এ্যারিয়েল শ্যারণ মসজিদুল আল-আকসাকে অপবিত্র করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস তো সেই ফিলিস্তিনি যিনি তার অনুসারি ফিলিস্তিনি ভাইদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন যারা জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী করার ব্যাপারে কোনো আপোষ না করে প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছিলেন।
গত দুই দশক ধরে আরব, মুসলিম ও বিশ্ব নেতারা জানেন ট্রাম্পের জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণার দিনটি আসবে কারণ ১৯৯৫ সালে মার্কিন কংগ্রেস জেরুজালেম এ্যামবেসি এ্যাক্ট অনুমোদনের জন্যে গ্রহণ করেছিল। এই এ্যাক্টেই যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারকে তেলআবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। আরব অঞ্চলে উত্তেজনা যাতে বৃদ্ধি না পায় ট্রাম্পের উত্তরসূরীরা তা বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত ছিলেন। এদিক ওদিক মার্কিন নেতারা এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য রাখলেও দুই দশক ধরে তা বাস্তবায়নের সাহস পাননি যা পেলেন ট্রাম্প। তার আগে অবশ্য এধরনের প্রস্তাব আইনে পরিণত করা হয়েছে।
ফিলিস্তিনিরা ভাল করেই জানেন মার্কিনীরা ইসরায়েলের তাদের ভূমি জবরদখলের পক্ষে। শান্তি আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র সেরা ‘ব্রোকার’। ধারাবাহিকভাবে মার্কিনীদের জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা দেওয়ার এ প্রক্রিয়া দুই দশক ধরে চললেও ওআইসি, আরব লীগ মৌনতার সঙ্গে তা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করেনি। এমনকি মাহমুদ আব্বাসের মত ফিলিস্তিনিরা তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেও সৌদি ধমকে নিশ্চুপ হয়ে থেকেছেন কেবল।
ট্রাম্প তাই বলতে সাহস করছেন, যদিও গত সত্তর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেওয়া থেকে বিরত ছিল, কিন্তু চূড়ান্তভাবে সে ঘোষণাই করছি। বাস্তবতায় এটি কমও নয় বেশিও নয়। এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত এবং যা বাস্তবায়ন করার মত ব্যাপার। এটা আসলে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে সমস্ত বিশ্বনেতাদের কাছে প্রশ্ন করার এক নিজস্ব কৌশল কেন তারা এতদিন ধরে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমের স্বীকৃতি মেনে নেননি।
ট্রাম্প আরো ব্যাখ্যা করে বলেছেন, আজ জেরুজালেম আধুনিক ইসরায়েলি সরকারের জন্যে এক আসন। ইসরায়েলি সংসদের গন্তব্য। ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালতেরও। জেরুজালেম ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ঠিকানা। বিভিন্ন দেশের সরকারের মন্ত্রীদের এখন এখানেই আসতে হবে। একারণেই দশকের পর দশক ধরে মার্কিনীরা ইসরায়েলিদের সঙ্গে জেরুজালেমে বসেই শলাপরামর্শ করেছে। হয়ত সৌদি আরব, আমিরাত, মিসর থেকে বিমানে করে শাসকরাও জেরুজালেমে এসে নামবেন। তাহলে ট্রাম্প এই অনিবার্য ঘোষণায় কেন বিলম্ব করবেন?
আস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন